ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২২ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ইলিশ কথকতা

ইলিশ নিয়ে ইদানিং রাজনীতি হয়, রাষ্ট্রীয় গিফ্‌্‌ট হয়, ইলিশের ‘জিন’ সিকোয়েন্স নির্ণয় হয়। ইলিশ নিয়ে শুধু আলাদা একটা মন্ত্রণালয় বাকী। এসব আমাদের লেখার বিষয় নয়। তবু ও কথায় কথা এসে যায়-এই আরকি!

ইলিশ নিয়ে আমেরিকায় প্রবাসী এক বাংগালীর সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়া লেগেই থাকে। লোকটা সখ করে ইলিশ আনে। বউ যত্ন করে রাধে। তারপরও লোকটার ঝগড়া। তার বক্তব্য হচ্ছে ছোটকালে তার নানী ইলিশ রান্না করলে গোটা এলাকায় সুগন্ধ ছড়াত আর এখন এত দামে ইলিশ কিনে কোন গন্ধও নাই, স্বাদও নাই। বউ নিশ্চয় রান্নার তরীকা জানে না। বউও কম যায় না। বউ বলে তোমার নানীর কাছে যাও। গন্ধ, স্বাদ ওয়ালা ইলিশ খেয়ে আস।

ইলিশ নিয়ে আমারও একটা বিচিত্র স্মৃতি আছে। ষাটের দশকে আমাদের এলাকায় ইলিশ আসতো সপ্তাহ দুইবার অর্থাৎ হাটের দিন। তাও ট্রেনে ইলিশ পৌছত বিকেল ৪ টায়। রাত অবধি যা বিক্রি হয়। আমাদের এলাকায় সাগরের মাছ যাওয়ার তেমন প্রচলন ছিল না। শুধু লইট্যা আর ইলিশ মানুষে খেত ‘সীজনে সীজনে।’ লইট্যাকে বলা হত পশ্চিম কূলের মাছ অর্থাৎ সীতাকুণ্ড পাহাড়ের পশ্চিমে অর্থাৎ উপকূলীয় সাগরের মাছ। আর ইলিশকে বলা হত ‘ট্রেনের মাছ।’ আমি হাটের শুরুতে কেজি ২ টাকা দামের বড় ইলিশ নিয়ে বাড়ি চলে আসতাম। আসলেই ইলিশের রান্নার খবর হত উঠান-আঙ্গিনায়। কিন্তু সন্ধ্যা হলে মা আমাকে টাকা দিয়ে আবার বাজারে পাঠত শেষ হাট (Late Shopping)র ইলিশ কিনতে। লক্ষ্য করতাম বিকেলে ২ টাকা কেজি বিক্রি করলও সন্ধার পর তা ১ টাকা আরো পরে আট আনা/ বার আনাতেও বিক্রি হত। লেট-শপিং এর ইলিশ ফ্রাই করে রেখে দেওয়া হত।

বলা হয়, বড় লোকদের করোনা না হলে এত দ্রুত ‘ভ্যাকসিন বের হত কিনা সন্দেহ। একইভাবে বড় লোকদের পোলাপাইন পান্তা-ইলিশ না খেলে অথবা মাওয়া ঘাটে ধুমধাম ইলিশ খাওয়া না হলে ইলিশ নিয়ে এত মাতামাতি হত কিনা জানিনা। ইলিশ নিয়ে ইংরাজী-বাংলা মিশ্রিত গানও আছে। আসলে ইলিশ কখনো আম-জনতার খাদ্য ছিল না। এটা বরাবরই বড় লোকদের খাদ্য।

‘ইল’ শব্দের অর্থ জল, ঈশ মানে ঈশ্বর। মাছের রাজা ইলিশ-এটারও একটা গল্প আছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী কবি নির্মলেন্দু গুন কবিসুলভ অভ্যাসে বেশ রাতে হাটতে বেরিয়েছেন। টহলদার পুলিশ উনাকে ধরে জিজ্ঞেস করে এত রাতে রাস্তায় কি করছেন? কবি নির্মলেন্দু বললেন-আমি কবি মানুষ। আমাকে ধরে এসব কি হচ্ছে? পুলিশরা বললেন-দেখি দুই লাইন কবিতা বলেন তো! কবি সুন্দর করে বলে ফেলেন-

মাছের রাজা ইলিশ
মানুষের রাজা পুলিশ।

সেই থেকে বলে আসছে মাছের রাজা ইলিশ-প্রবাদ। রাজসমতুল্য মাছ কি কখনো আম জনতার ভাগ্যে জোটে! তাই তো পশ্চিম বংগের কিংবদন্তী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক দশক আগে কোলকাতার বাজারে ৫০০ টাকা কেজি ইলিশ দেখে ক্ষোভে অভিমানে বাজার না করেই বাসায় ফেরৎ যান।

বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ মাত্র। বার্মা, ও গুজরাট, করাচীর আরব সাগরের উপকূলে কিছু ইলিশ পাওয়া যায়। করাচী ও গুজরাট উপকূলে ইলিশকে ‘পাল্লা’ বলে। কাটার কারনে ওরা তেমন ‘পাল্লা’ বা ইলিশ খায় না। ইলিশ সারা বছর সাগরেই থাকে। শুধু ডিম ছাড়ার জন্য নদীর স্রোতে আসে। মূলতঃ পদ্মা, মেঘনার স্রোতেই ইলিশ ডিম ছাড়ে। পানি প্রবাহের উজানে সাতার কাটে বলে নদীর মাছে চর্বি বেশি। এগুলোই মাছকে সু-স্বাদু করে। আবার নদীতে প্লাংটন। জলজ উদ্ভিদ বেশী বলে নদীর ইলিশ সুস্বাদু হয়। সাগরের ইলিশ তুলনামূলকভাবে কম স্বাদের। পুষ্টির বিচারে নদীর ইলিশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ইলিশে থাকে ওমেগা এ, ফ্যাটি এসিড, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্কের গঠন ও ক্রিয়া এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে পজিটিভ ভূমিকা রাখে।

ইলিশ নিয়ে যত সাহিত্য তা আধুনিক যুগে। প্রাচীন সাহিত্যে ইলিশের উল্লেখ না থাকার একটা কারণ হয়তো এটা কখনো গরীব-দুঃখী, আম জনতার খাদ্য ছিল না। এজন্য প্রাচীন বাংলার প্রাকৃত মঙ্গল, মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল, বিজয় গুপ্তর মনসা মংগল প্রভৃতি কাব্যে গরীবের মাছ পুষ্টি, মলা, টাকি ইত্যাদির উল্লেখ থাকলেও ইলিশের উল্লেখ দেখা যায় না। যেমনঃ ইচা, পুটি, কৈ শিং টাকি টেংরা, বৈচা আরো কত কি। সেনাপতি মানসিংহ বাংলার বার ভুইয়াদের দমনে বাংলার ভাটি এলাকায় দীর্ঘদিন থাকলেও তার লোক কবিরা বারবার কৈ, মাগুরের কথা উল্লেখ করলেও ইলিশের উল্লেখ দেখা যায়না।

তবে গ্রামে গঞ্জে ইলিশ নিয়ে অতি উচ্চ মার্গীয় কিছু ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। যেমনঃ

পুই শাকে যদি দাও ইলিশের মাথা
ননদিনী কয় তার গুপ্ত যত কথা।
ভারতবর্ষের উড়িশ্যা রাজ্যে একটা প্রবাদ আছে-
মাছা খাও তো ইলিশ
চাকরী করতো পুলিশ

তবে ইলিশকে সত্যিকার সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন মানিক বন্দোপাধ্যায় তার কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝিতে। জেলে কুবের এর ভাষায়-নৌকার করে জমতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ, লন্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে। নিষ্পলক চোখগুলো স্বচ্ছ নীলাঙ মনির মত দেখায়। আরো পরে শৈবাল মিত্রের ‘ইলিশের রাত’ গল্পে দারিদ্র ও ইলিশের কাহিনী বিচিত্র হয়েছে। ইমদাদুল হক মিলন ছোট্ট হরিন ও ইলিশ মাছ নিয়ে গল্প লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ নামে একটা কবিতা লিখেছেন ইলিশ মাছ নিয়ে।

ইলিশ নিয়ে দুটো বিয়োগান্ত ঘটনাও ঘটেছিল। দিল্লীর বাদশাহ গিয়াস উদ্দিন তুখলক জলদস্যুদের ধাওয়া করতে গুজরাট উপকূলে নৌকায় চলতে গিয়ে তার নৌকায় একটা ‘পাল্লা’ (ইলিশ) উঠে পড়ে। তুখলক এ মাছটা খেতে চাইলেন। উজির অমাত্য সবাই অপরিচিত মাছ খেতে নিষেধ করলেন। কিন্তু বাদশা নাছোড়বান্দা। এই ইলিশ খাওয়ার কয়েকদিন মধ্যেই তুখলকের মৃত্যু হয়। স্বামী বিবেকানন্দ গঙ্গার অববাহিকার ইলিশের ঝাঁক দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যান। পর পর চারদিন ইলিশ খান। দুদিন পরেই স্বামী মৃত্যু বরণ করেন। তুমলক, স্বামী বিবেকানন্দের ভাগ্যে যে সবার হবে তাও নয়। এ পর্যন্ত এরকম কারো হয়নি। তাই ইলিশ খাওয়া চালিয়ে যান পকেট যতদিন গরম থাকে। ইলিশ বাংলাদেশের মানুষের আবেগের সাথে জড়িত। আম জনতা এই মাছ এফোর্ড করতে না পারলেও পঁচা ইলিশ, ঝাটকা (অনেক ব্যুহ ভেদ করে বাজারে আসে) ই বা মন্দ কি? মাছ না হলেও ঝোলের স্বাদ গন্ধই বা মন্দ কি? মাছের রাজার ঝোলও রাজকীয়।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে হৃদরোগ ও চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা
পরবর্তী নিবন্ধসাবেক এমপি বদির আত্মীয়ের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা