মহারাজ নন্দকুমার :
জুডিশিয়াল মার্ডার
রাজনীতিতে জুডিশিয়াল মার্ডার বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এই কথাটা প্রথম ব্যবহৃত হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এর মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝুলানো নিয়ে বাংলার তৎকালীন গভর্ণর ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিচারের কার্যবিবরণীতে। আমাদের পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন সকালে চোখ বুলালেই বহু দুর্নীতির চিত্র পাওয়া যায়, এসব দুর্নীতিতে শিক্ষিত,অর্ধ শিক্ষিত সবাই জড়িত। গ্রাম্য ভাষায় আলেম জালেম সবাই জড়িত। আসলে দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদি ব্যাপার নতুন নয়। সবসময়ই এসব ছিল, তবে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি উপমহাদেশে আমদানি হয় পলাশীর যুদ্ধের পর। ইংরেজ আমলে শুরু থেকে একটা গবেষণা থেকে দেখা যায় যে,ইংলিশ পূর্ব প্রশাসন অর্থাৎ নবাবী আমলে উচ্চপদস্থ আমলারা ঘুষ, দুর্নীতিতে ইংরেজদের থেকে কম ছিল। পলাশী পরবর্তী ইংরেজি এবং তাদের দেশীয় দোসররা বাংলার অর্থনীতিকে দারুণভাবে লুণ্ঠন করে। ইংরেজ গভর্নর ক্লাইভ, হেস্টিংস আপাদমস্তক ঘুষখোর ও দুর্নীতি করতো। এই ব্যাপক ঘুষ, দুর্নীতি বাংলায় ছিয়াত্তরের মনন্তর ঢেকে আনে। সিরাজ বিরোধী ও নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী অনেক দেশীয় ও বিত্তবানদের মাঝে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বীয় অবস্থান ও ক্ষমতা থেকে প্রতিরোধ করে। কিন্তু ষটতায় পটু ইংরেজরা। যারা নবাবদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করেছিল এদের সবাইকে ক্রমান্বয়ে সরিয়ে দেয় হত্যা করে। ইংরেজদের এহেন কূট রাজনীতির শিকার হন তাদেরই এককালীন সহযোগী মহারাজ নন্দকুমার। নন্দকুমারের প্র পিতামহ মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের বাসিন্দা। তিনি বিয়ে করে বর্তমান বীরভূমের ভদ্রপুর এ চলে যান। নন্দকুমারের পরিবারকে অনাচার দোষে বয়কট করে নিম্ন মুসলমান নবাব, অমত্যদের সাথে চলাফেরা, খাওয়া দাওয়াই ছিল সমাজে তাদের দোষ। নন্দকুমারের পরিবার এজন্য অত্যন্ত মনোকষ্টে দিন যাপন করত। মহারাজ নন্দকুমারের পিতা পদ্মনাভ মুর্শিদকুলি খাঁর আমল থেকেই রাজস্ব সংগ্রহ দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা দেখান। নন্দকুমার নিজ গ্রামে লক্ষীনারায়ন ও বৃন্দাবন চন্দ্র নামে দুটি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রহকালীর মন্দির এখনো বিদ্যমান। ভদ্রপুর নিজ বাড়িতে নন্দকুমার নিজ স্ত্রী ক্ষেমন্ধবীর নামে এক বিশাল দীঘি খনন করেন যেটা রাণীসাগর নামে এখনো আছে।
নন্দকুমার এর পিতা ছোটকাল থেকেই ছেলেকে নবাবের রাজস্ব আদায় ও জমির আমিন কাজ শিখিয়ে দক্ষ করে তোলেন। পিতার মৃত্যুর পর নবাব সিরাজের দরবারে ও তার যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। তিনি হুগলি, নদীয়া, বর্ধমানের রাজস্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নবাবকে বুঝিয়ে দিতেন। নবাবের বিরুদ্ধে তার নিকট আত্মীয়সহ জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখরা যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তা নন্দকুমার টের পান ও নিশ্চিত হন যে নবাবের পতন সন্নিকট। রাজস্ব আদায়ে সূত্রে ক্লাইভ, হোস্টিং সহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে তার যাতায়াত ছিল। মীরজাফর থেকে ১২০০ টাকা ঘুষ নিয়ে নন্দকুমার ই প্রথম ক্লাবের সাথে ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন বৈঠক করিয়ে দেন। নবাব সিরাজ নন্দকুমারকে চন্দননগরে ফরাসিদের সাহায্যের জন্য দৃত হিসাবে প্রেরণ করলে তিনি উল্টো ক্লাইভকে সব কথা ফাঁস করে দেয়। নন্দকুমারের সহায়তায় ক্লাইভ চন্দননগর দখল করে। এরপর থেকে নন্দকুমার ষড়যন্ত্রকারীদের দলে পূর্ণভাবে নাম লেখান। তাই মুর্শিদাবাদ থেকে বিতাড়িত হয়ে হুগলি চলে যান ও দারুণ অর্থকষ্টে পতিত হন। এ সময় হুগলির শেখ রোস্তম নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তাকে কষ্ট থেকে উদ্ধার করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস শেখ রোস্তম এর ছেলে কমর উদ্দিন নন্দকুমার বনাম রাষ্ট্রের মামলায় রাষ্ট্রের পক্ষে মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিলেন। নবাব সিরাজের মৃত্যুর পর মীরজাফর নবাব হলে ইংরেজরা তাকে প্রদত্ত অনেক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, ক্লাইভ, হেস্টিংস বেপরোয়াভাবে নবাবের অর্থ, মণিমাণিক্য লুট করে। এ ব্যাপারটা জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, মীরজাফরসহ ষড়যন্ত্রকারীরা পছন্দ করেননি। ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ইংরেজদের দূরত্ব তৈরি হয়। এহেন পরিস্থিতিতে মীরজাফর একমাত্র নন্দকুমারকেই ইংরেজদের সাথে টাকা লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। নন্দকুমার ক্লাইভ ও হেস্টিংস থেকে মীরজাফর ও তার স্ত্রী সন্তানদের মাসোহারা বন্দোবস্তের জন্য তৎকালীন চার লক্ষ টাকা ঘুষ দেন।
কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যাপক দুর্নীতির জন্য আমজনতা ও উচ্চ পদস্থ বাঙালিরা ও ইংরেজ বিরোধী হয়ে ওঠে। এদিকে নন্দকুমার এর মধ্যেও ইংরেজদের ব্যাপক ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোহভঙ্গ ঘটে। নন্দকুমার ক্লাইভের প্রিয় ছিল বলে হেস্টিংস এমনিতেই নন্দকুমারকে প্যাচে ফেলতে চাইতো। ক্লাইভের বিলাত ফেরত গেলে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্ণর হলে নন্দকুমারের দুর্ভাগ্য শুরু হয়। এসময় হেস্টিংস নন্দকুমার এর বিরুদ্ধে খাজনা আত্মসাতের অভিযোগ করে। নন্দকুমার সাক্ষী প্রমাণ ও লিখিত রশিদ প্রদর্শন করে এসব অভিযোগ থেকে রেহাই পাই। ছিয়াত্তরের মণন্তরের সময় দুই প্রভাবশালী নেতা নন্দকুমার ও রেজা খার মধ্যে সংঘাত লাগে। হেস্টিংস হিন্দু মুসলমান দুই নেতার মধ্যে সংঘাতকে তার শত্রু নন্দকুমার কে শায়েস্তা করার মোক্ষম সুযোগ রূপে ব্যবহার করেন। ইতিমধ্যে কলিকাতায় সুপ্রিম কোর্ট চালু হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়ে আসেন ইম্মে সাহেব। ছিলেন লন্ডনে হেস্টিংয়ের ক্লাসমেট। হেস্টিং ভাবলেন আইন দিয়ে নন্দকুমারকে ফাঁসাতে হবে।
হেস্টিংস নন্দকুমার এর শত্রু খুঁজে বের করলেন তিনজন। মোহন প্রসাদ, কৃষ্ণ জীবন ও কামাল উদ্দিন। নন্দকুমার বুলাকিদাস নামে এক মাড়োয়ারির কাছে কাছে ৪৮০২১ টাকা প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এই কর্জ শোধ না করে তার মৃত্যু হয়। বুলাকীদাস ও নন্দকুমারের কর্জে সাক্ষী ছিল মোহন প্রসাদ ও কামাল উদ্দিন।
এদের সহায়তায় হেস্টিংস নন্দকুমার এর বিরুদ্ধে জাল দলিলের মাধ্যমে বুলাকীদাসের বংশধরদের থেকে টাকা আত্মসাতের মামলা করে দেন আদালতে। মোহন প্রসাদ ও কৃষ্ণ জীবন বুলাকী মাড়োয়ারির কর্মচারী ছিল। আর কমল উদ্দিন ছিল যে শেখ রোস্তম নন্দকুমারের আর্থিক দৈন্যে সাহায্য করেছিল তার ছেলে। মূল দলিলের সাক্ষী মোহন প্রসাদ এর মৃত্যু ঘটলে কমর উদ্দিন ও কৃষ্ণ জীবন হেস্টিংস এর পক্ষে ওই দলিল জাল বলে সাক্ষী দেয়। কমল উদ্দিন তার সই অস্বীকার করে আর কৃষ্ণজীবন মোহন প্রসাদ ও বুলাকি দাসের হস্তলিপি জাল বলে শনাক্ত করে। জালিয়াতির শাস্তি বড়জোর যাবত জীবন জেল হতে পারে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি ও হেস্টিংসের ক্লাসমেট ইম্পে নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ দেন। এরকম একটা জাল ও অন্যায় রায়ে নন্দকুমার স্তম্বিত হয়ে যান।
নন্দকুমার কুলীন ব্রাহ্মণ। জেলে মুসলমান ও নিচু গোত্রের সাথে আহারাদি করলে পাপ হবে মনে করে কয়েকদিন না খেয়েই থাকেন। হেস্টিংস চারজন ভাড়া করা ব্রাহ্মণ এনে শাস্ত্রীয় বিধান দেয় যে, অন্যদের সাথে আহার করলে জাত যাবে না। ইংরেজদের বাটপারিতে নন্দকুমার আরো ব্যথিত হন। তার শবদেহ বহনের জন্য তিনি নিজে চারজন ব্রাহ্মণ এর নাম লিখে দেন। ১৭৭৫ সালের ৫ই আগস্ট তার ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। ওই রাতে ব্রাহ্মণ হত্যায় ব্রহ্মার ক্রোধ হবে মনে করে ও প্রায়শ্চিত্ত করার মানসে ৫০ হাজার কলকাতাবাসী গঙ্গা জলে কোমর পানিতে ডুবে থাকেন।
তার পরবর্তী ইতিহাস আরো চমকপ্রদ। বিলাতের পার্লামেন্টে নন্দকুমারকে অর্থনৈতিকভাবে ফাঁসি দেওয়ার অভিযোগে হেস্টিংসকে ইমপিচ করার আবেদন করেন এডমন্ড বার্ক ও মেকলে। বিচারক দুইদিন এই রায় পাঠ করেন। কিন্তু বিচার চলাকালে কলকাতার বহু অভিজাত হেস্টিংসের নির্দোষ পত্রে সই করে রাণীর কাছে হেস্টিংস এর মুক্তির আবেদন করেন। ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য যে,নন্দকুমারের নাতি ও হেস্টিংসের মুক্তির পত্রে সই করেন।
বিচারের রায়ে হেস্টিংসকে দায়মুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ব্রিট্রিশ পার্লামেন্টেরিয়ান এডমন্ড বার্ক নন্দকুমারের ফাঁসিকে ‘জুডিশিয়াল মার্ডার’ বলে অভিহিত করেন। বিচিত্র ভারতবাসি। তাদেরকে আরো বিচিত্র করে দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন। নন্দকুমারের ফাঁসি বৃটিশ শাসনের প্রথম অন্যায় ও জাল সাক্ষীজনিত ফাঁসি। বৃটিশদের রেখে যাওয়া ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার দম্ভ থেকে উপমহাদেশ এখনো মুক্তি পায়নি। এটাকেই কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা ‘রক্তের দোষ’ বা ঝরহং ড়ভ ঋষবংয নামে অভিহিত করেছে এক সম্পাদকীয়তে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক