লেখক ও পাঠক
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে না লিখে কেন অন্যান্য দেশ বিশেষত ভারত সম্বন্ধে এত বেশি লিখি। তারও কারণ আছে। আমাদের দেশের বর্তমান সমাজ অত্যন্ত অসহিষ্ণু। মানুষ কবি-সাহিত্যিক-কলামিস্টদের লিখা নিয়ে কেউ ব্যক্তিগত, কেউ সমষ্টিগত আবার কেউ রাজনৈতিক রূপ-রস নিয়ে ‘অফেনডেড’ (offended) বোধ করেন। ভারতের বর্তমান সমাজও অনুরূপ। অথচ দুই যুগ আগেও সমাজ এমন ছিল না। শিল্পী সাহিত্যিকরা দেশেরই সন্তান। তারা একটি দৃশ্য হয়তো অন্যদের থেকে ভিন্ন আংগিকে দেখেন। অনুভূতি ও পারসেপশনে পার্থক্য থাকাটাই মানবিক ও স্বাভাবিক। যেমন পারসী কবি ওমর খৈয়ামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল উনি গোলাপে কি দেখেন? খৈয়াম উত্তরে বলেন-একজন সাধারণ মানুষ গোলাপে কাঁটা, মধু, ঘ্রাণ ইত্যাদি দেখেন। আর খৈয়াম গোলাপে পারস্যের রাজ-দরবার, সুরা, সাকীর অনন্ত বৈচিত্র্য দেখেন। ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত না দিয়ে যে সাহিত্য, শিল্প সৃষ্টি হয় তা সমাজের, রাষ্ট্রের দর্পণ।
একবার আমি ডাক্তারদের পিকনিকে গিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে মাইকে পশ্চিম বাংলার গণমুখী গায়ক নচিকেতার গান বাজছিল মাইকে! ‘বৃদ্ধাশ্রম’ থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের সব গান ডাক্তাররা উপভোগ করলেন। কিন্তু যেই নচিকেতার “ও ডাক্তার… গানটা বাজা শুরু হল তখন সবাই হৈ চৈ করে ওটা বন্ধ করে দিল। অথচ ভারতে কোথাও তার বিরুদ্ধে মামলা-হামলা হয়নি। নচিকেতার একটা অনুভূতি -ও ডাক্তার গান। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে আপনি শিল্পীর সৃষ্টি উপভোগ করলেন। আর সমষ্টিগতভাবে বিব্রত বোধ করলে দাংগা হাংগামা হবে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা এ রকম পরিস্থিতিতে ব্যাহত হয়।
স্যাটায়ার বা হাস্যরস, গাল-গল্প এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য। না হলে ছোটকাল থেকে গোপাল ভাঁড়ের গল্প শোনা হত না। পাকিস্তানের শেষ বছর ও বাংলাদেশ আমলে কার্টুনিস্ট “রণবী” তার কার্টুনে চিত্রিত করেন নাই এমন কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নেই। মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াই সৃষ্টি কর্ম করে গেছেন। একবার বরের মা ও কনের মার বিবাহোত্তর অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় ক্যাপশন দিয়ে একটা লিখা লিখেছিলাম দৈনিক আজাদীতে-“কন্যার মা ছল্লত ছল্লত, পোয়ার মার লানত”। আমার দুইজন উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার বন্ধু অত্যন্ত অশালীন ভাষায় আমাকে অভিযুক্ত করলেন। “অ- ভাই-কি লিখা লিখলা, তুমি তো আমার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিলে?”
এই যখন শিক্ষিত পাঠকের অবস্থা তখন আপনি যাবেন কোথায়? লিখবেনই বা কি? আকবরের নবরত্ন সভার মত ফরমায়েশী বুদ্ধিজীবীর সৃষ্টি হবে সমাজে ?
ভারতের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে অসংখ্য দেব দেবীর বহুমাত্রিক দৈহিক অবয়বের চিত্র অংকিত আছে পৌরাণিক কাল থেকে। এগুলোই এসব উপাসনালয়ের সৌন্দর্য্য ও বৈচিত্র্য। এসব অবয়বী চিত্র সাধারণ মানুষ মানুষীর অবয়ব চিত্রের হুবুহু নকল নয়। ওগুলোর অন্যরকম বিশ্লেষণী মাত্রা আছে। যেমন আছে ওমর খৈয়ামের গোলাপ দেখা আর অন্য দশজন আম জনতার গোলাপ দেখার মাঝে। অথচ একই চিত্র প্রদর্শনের জন্য ৯০ বছরের বিশ্ব নন্দিত চিত্রশিল্পী “হুসেইনকে ভারত ছাড়তে হয়েছে” এ রকম অসহিষ্ণুতা দুইযুগ আগেও ছিল না।
ধর্মীয় উন্মাদনা ভারতে বরাবরই কম বেশি ছিল। নেহেরু-দেশাই-ইন্দিরা-বাজপেয়ী সব আমলেই সাম্প্রদায়িক হাংগামা ছিল। কিন্তু উল্লেখিত সময়ে ভারতের নেতৃত্বের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতের প্রতি একটা ন্যূনতম শ্রদ্ধাও থাকত।
ভারতের দু’জন নামকরা কার্টুনিস্ট আর. কে. লক্ষণ ও কে শংকর পিল্লাই। পিল্লাই কেরালার লোক ও আর. কে লক্ষণ মহীশূর এর। দুজনেরই কার্টুনে হাতে খড়ি মাদ্রাজ বা চেন্নাইয়ের পত্রিকা ‘দি হিন্দুতে’। আর কে লক্ষণ আগাগোড়া টাইমস অফ ইনডিয়াতে চাকরি করেছেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর লক্ষণ নেহেরুকে নিয়ে এক অসাধারণ বিদ্রুপাত্মক কার্টুন আঁকেন টাইমস অফ ইনডিয়ায়। নেহেরু মানহানির মামলা বা তাকে জেলে না পাঠিয়ে এক কাণ্ড করে বসলেন। নেহেরু লক্ষণকে ফোন করেন। “I enjoyed your cartoon, can you send me a signed copy of it? ” তোমার কাটুর্নটা আমার খুব ভাল লেগেছে। তুমি স্বাক্ষর করে একটা কপি আমাকে পাঠিয়ো। এটাই তৎকালীন ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও নেতাদের বিরোধী মন্তব্য গ্রহণ করার সাহস ও বিজ্ঞতা (WISDOM)। একই ঘটনা ঘটেছে ১৯৫৪ সালে কার্টুনিস্ট শংকর পিল্লাইকে নিয়ে। শংকর রাষ্ট্রের দুই প্রধান স্তম্ভ নেহেরু ও আম্বেদকারকে নিয়ে এক কার্টুন আঁকেন পত্রিকায়। এটা নিয়ে পার্লামেন্ট সর্বসম্মতি নিন্দা জানায়। দু বছর পর স্বয়ং নেহেরু শংকর পিল্লাইকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই”। বাংলা অর্থ যত জোরালো ইংরেজি তরজমা আরো অর্থবহ- Those days are gone. ভারতে এখন ভিন্ন মতাবলম্বীদের অবস্থা ভাল নয়। ইনকাম ট্যাক্সের হামলা থেকে পুলিশী মামলা বা হত্যা যে কোন কিছু ঘটতে পারে। ২০১৭ সালের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট অনুযায়ী এক বছরে ভারতে ১১ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ৮ জনের উপর হামলা হয়েছে, ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সর্বশেষ সাংবাদিক গৌরী লাংকেশকে ঘরে ঢুকে ব্যাংগালোরে হত্যা করা হয়।
আমার এলাকায় ১৯৬৬ ব্যাচের একজন সিএসপি অফিসার ছিলেন। সততা, মেধায় তার তুলনা হয় না। বাংলাদেশে, বিদেশে উঁচু পদে চাকরি করেছেন। অবসরের বছর খানেক আগে তার বিভাগের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তার বিরুদ্ধে মামলা টুকে দেয়, নিজে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে আদালতে তার সাজা হয়ে যায়। ঐ অপমানেই তার রোগ শয্যা ও মৃত্যু।
সহনশীলতা সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য। এটা চর্চার অভাবে সমাজ বিপর্যস্ত হয়। সংস্কৃতি ও শিল্পে ব্যাঘাত ঘটে। পুরোনো নেতাদের থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়। কিন্তু কে কার কথা শোনে?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও চিকিৎসক