নগরীর সার্সন রোডের নিউ লাইফ অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল ওষুধ সেবন করানো এবং অবহেলার ফলে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিতে কর্মরত চিকিৎসক ডা. সমৃদ্ধি চৌধুরীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় আদালতে একটি নালিশি মামলা দায়ের হয়েছে। বাকি দুজন হলেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন চক্রবর্তী ও চমেকের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ।
গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে ভিকটিম কিশোরীর পিতা পলাশ কুসুম নন্দী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। বাদীর আইনজীবী পার্থ প্রতীম নন্দী আজাদীকে বলেন, অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ তুলে আমার মক্কেলের দায়ের করা মামলাটি আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে আদালত বাদীর জবানবন্দিও গ্রহণ করেন।
মামলার আরজিতে বলা হয়, ভিকটিম প্রজ্ঞা নন্দী প্রকাশ মেঘার বয়স ১৪ বছর। সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। কয়েক মাস আগে তার মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা ও বমির উপসর্গ দেখা দেয়। এজন্য ভিকটিমকে গত ১৫ মার্চ চমেক হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল আলম খন্দকারকে দেখানো হয়। তিনি মেঘার সমস্যাটিকে মাইগ্রেনজনিত মাথা ব্যথা হিসেবে ধরে নিয়ে কিছু ব্যথানাশক ওষুধ দেন এবং আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেঘার ব্রেনের সিটি স্ক্যানসহ কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে বলেন। এছাড়া মেঘাকে গত ২৫ মার্চ চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. পঞ্চানন দাশকে দেখানো হয়। তিনিও মেঘার সমস্যাকে মাইগ্রেনজনিত ব্যথা হিসেবে ধরে নিয়ে ওষুধ দেন এবং সিটি স্ক্যানসহ কিছু পরীক্ষা করাতে বলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ নগরীর ম্যাঙ হাসপাতালে মেঘার ব্রেনের সিটি স্ক্যানসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করানো হয়। এসব পরীক্ষার ফলাফল নরমাল আসে উল্লেখ করে আরজিতে বলা হয়, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডা. মো. মাহবুবুল আলম ও ডা. পঞ্চানন দাশ দুজনই মেঘার মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা দেখা দেওয়ার বিষয়টিকে মাইগ্রেনজনিত ব্যথা হিসেবে নিশ্চিত করেন।
আরজিতে বলা হয়, ভিকটিম মেঘার রোগ সম্পর্কে আরো সঠিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ও নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শিউলী মজুমদারকে দেখানো হয়। তিনিও অন্যদের মতো রিপোর্ট পরীক্ষা করে মেঘার মাথা ব্যথাকে মাইগ্রেনজনিত ব্যথা হিসেবে উল্লেখ করেন।
আরজিতে আরো বলা হয়, চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করানোর পর এবং সঠিক জীবন–যাপনের ফলে মেঘার মাথা ব্যথা প্রায় উপশম হয়ে যায়। কিন্তু গত ১ জুন ফের সামান্য মাথা ব্যথা ও বমি দেখা দিলে মেঘাকে চিকিৎসকদের দেওয়া ওষুধ সেবন করানো হয়। এতে মেঘা সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরদিন ফের শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল অনুভব করলে তাকে নগরীর সার্সন রোডের নিউ লাইফ হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়া হয়। মেঘাদের বাসা ছিল ব্যাটারি গলিতে। সেখান থেকে কাছে হওয়ায় সার্সন রোডের এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেঘাকে নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে আরজিতে বলা হয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিতে নেওয়ার পর প্রথম দিকে মেঘার সমস্যাকে তেমন কিছু না বলে উল্লেখ করা হয়। স্যালাইন দিলে ঠিক হয়ে যাবে বলা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মেঘাকে ক্যানোলার মাধ্যমে কিছু ইনজেকশন পুশ করা হয় এবং কিছু ট্যাবলেট সেবন করানো হয়। ২০ মিনিট পর মেঘাকে একটি স্যালাইন দেওয়া হয় এবং স্যালাইনের মধ্যে অপর একটি ইনজেকশন দেওয়া হয়।
আরজিতে বলা হয়, স্যালাইন দেওয়ার ২০ মিনিট পর মেঘা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জানতে চাইলে বলা হয়, দুর্বলতার কারণে মেঘা সেন্সলেস হয়েছে। পরবর্তীতে মেঘার জ্ঞান ফিরে আসে উল্লেখ করে বলা হয়, জ্ঞান ফিরে আসার পর মেঘাকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির ১০১ নম্বর কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। স্যালাইন দিলে ঠিক হয়ে যাবে বলার পর এতরকম কর্মকাণ্ড কেন, কোনো সিনিয়র কনসালটেন্ট প্রয়োজন আছে কিনা, অন্য কোনোভাবে চিকিৎসা প্রদানের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে বলা হয়, ভিকটিমের সুস্থতার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো সিনিয়র কনসালটেন্ট ভিকটিমের চিকিৎসার জন্য আসেননি। একপর্যায়ে সর্বশেষ পরস্থিতি কী জানতে চাইলে বলা হয়, সিনিয়র কনসালটেন্টের পরামর্শ ব্যতীত মেঘাকে আর কোনো চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। এর ফলে মেঘা দীর্ঘ সময় চিকিৎসাহীন অবস্থায় ছিল উল্লেখ করে আরজিতে বলা হয়, একপর্যায়ে সিনিয়র কনসালটেন্ট ৩ নম্বর আসামি ঘটনাস্থলে আসেন। কিন্তু তিনি মেঘাকে জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদানের কোনো পরামর্শ দেননি এবং চলে যান। এ সময় ভিকটিমের অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ করে মেঘার হাতের নখ, ঠোঁট ও পা কালো হয়ে যায় এবং সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে লালা আসতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতেও আসামিরা কোনো উদ্যোগ নেননি জানিয়ে বলা হয়, ১ নম্বর আসামি তখনও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বারবার অনুরোধ করা হলেও কর্ণপাত করা হয়নি।
ভিকটিমের নাকে দুটি অঙিজেন পাইপ বসিয়ে দেওয়া হয় জানিয়ে বলা হয়, অবস্থার অবনতি দেখে অন্য কোথাও রেফার করতে বললে তারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসছে বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। ভিকটিমকে একদম নিস্তেজ হতে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বললেও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। পালস দেখতে বললেও কর্তৃপক্ষ কোনো সাড়া দেননি। উল্টো বলা হয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া তারা কিছুই করতে পারবেন না। একপর্যায়ে বাদী উত্তেজিত হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কাছে কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স এনে নিতে পারলে নিয়ে যেতে বলা হয়। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স এনে পার্কভিউ হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মেঘাকে মৃত ঘোষণা করেন। ভিকটিমের লক্ষণ দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক সন্দেহ করেন, ভুল ওষুধ ও অবহেলার কারণে স্ট্রোক হয়ে মারা গেছে।