বাপন রাতে একা একাই ঘুমায়। তার কোনো ভয় করে না। এ জন্য তার মা সবার সাথে খুব গর্ব করে বলে- আমার বাপন অনেক বড় হয়ে গেছে। একা ঘুমাতে আর ভয় পায় না।
প্রথম প্রথম যদিও একটু ভয় লাগতো। বেশ কান্না করতো। কিন্তু এখন তার ভালোই লাগে। রাতের পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া শেষ করে- দাঁত ব্রাশ করে সে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পড়েই গভীর ঘুমে হারিয়ে যায়। সকালে নিজের থেকেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।
আজও যথারীতি সে একা একা ঘুমুচ্ছে। গায়ের উপরে কাঁথা দেওয়া। হঠাৎ সে টের পায় তার পাশে কে যেন চুপিচুপি এসে শুয়ে পড়ে। তার গায়ে ছোঁয়া লাগতেই সে ভয়ে আঁতকে উঠে। ভীষণ গরম। একদম গনগনে আগুনের মতো। বাপনের শরীর মনে হয় যেন পুড়ে যাবে। সে ভয়ে জোরে চিৎকার করতে চায়।
-কে, কে বলে উঠে। কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। মনে হয় কে যেন তার গলা চেপে ধরেছে। পাশে থেকে হঠাৎ একটি ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠ বলে উঠে-
বাপন, আমি ভূতের বাচ্চা ভুতো।
এ কথা শুনে বাপন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে- ও বাবারে ভূত। ও মা ভূত, ভূত।
পাশে থেকে তখন ভুতো বলে উঠে- ভয় পেয়ো না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।
ভুতোর কথা শুনে বাপনের বুকে সাহস আসে। কিন্তু সে ভরসা পায় না।
-তুমি ভূত। ভূতের বাচ্চা। আমার কাছে কী চাও? নিশ্চয়ই আমার সাথে ভাব করে পরে আমার ঘাড় মটকে দেবে।
-না, না মোটেও তা নয়। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। ফ্যাঁসফ্যাঁসে কন্ঠে ভুতো কথা বলে। তার কথার সাথে সাথে যেন তার শরীরও কেঁপে উঠে।
– কোথায় পেলে এমন আজগুবি কথা। ভূত আর মানুষ কি কখনও বন্ধুত্ব হয়!
– কেন হবে না। তুমি আর আমি বন্ধু হলেই তো হবে।
– মোটেও না। তুমি আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে শেষে আমার ঘাড় মটকে দেবে।
– না, বাপন। তেমনটি হবে না। আমি সত্যিই তোমার বন্ধু হতে চাই। তোমার সাহায্য আমার খুব দরকার। দেখো, আমার গায়ে অনেক জ্বর।
ভুতোর কথা শুনে বাপন হেসে উঠে- হা, হা। হাসালে। ভূতদের আবার কখনও জ্বর হয় নাকি। তোমরা তো সারাদিন থাকো পঁচা পুকুরের কালো কালো কাঁদামাটির নিচে, না হয় বট গাছের মগডালে। তোমাদের শীত গ্রীষ্মই কী আর সর্দি জ্বরই বা কী?
-না, বাপন আমার সত্যিই অনেক জ্বর।
-তা আমার কাছে কী চাও? আমি কী করবো? প্যারাসিটামল দেবো? খাবে?
-না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমাকে একটু তোমার পাশে কাঁথার মধ্যে শুতে দাও তাহলেই হবে। আমার বেশ আরাম লাগছে।
– তোমার কথা শুনে সত্যিই হাসি পাচ্ছে। ভূতদের আবার জ্বরও হয়। তাদের আবার কাঁথার নিচেও শুতে হয়।
-আসলে পুরো ব্যাপারটা তোমাকে খুলেই বলি। আমাদের ভূত সমাজে কারো জ্বরটর হতে কখনও দেখিনি। এমনকি শুনিও নি।
– তাহলে তোমার জ্বর হলো কীভাবে? তার মানে তুমি কি ভূত না? মিথ্যে অভিনয় করছো?
-আমি ভূত না হলে তোমার বন্ধ ঘরে ঢুকলাম কী করে?
ভুতোর কথা শুনে বাপন আবার একটু ভয় পায়। ভুতো বাপনের অবস্থা দেখে বেশ মজা পায়।
-ভয় পেয়ো না। আমরা এখন বন্ধু। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তোমাকে সবকিছু খুলে বলছি।
– তা বলো। জ্বরটা বাঁধালে কীভাবে?
– সেটাই বলছি। আসলে আজ দুপুরে তোমাদের পাশের বস্তির ছেলে মেয়েগুলো যখন খেলা করছিল তখন আমিও তাদের সাথে আড়ালে থেকে খেলছিলাম। তাদের মধ্যে ছোট একটা মেয়ের গায়ে জ্বর ছিল। ওর গায়ে থেকেই মনে হয় ভাইরাস আমার গায়ে চলে এসেছে। দুপুরের পর থেকেই দেখি কেমন কেমন জানি লাগছে। তারপর তো দেখি কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠছে।
-বাব্বা। এ তো দেখি এক্কেবারে বিজ্ঞানী ভূত। ভাইরাসও চিনে। তা কাঁথার নিচে আসার আইডিয়া তোমার মাথায় কীভাবে আসলো?
– আসলে আমাদের ভূত সমাজে কারও কখনও জ্বর হতে দেখি নি। তাই ভাবলাম আমার জ্বর হয়েছে জানলে যদি আমাকে ভূত সমাজ থেকে বের করে দেয়। তাই কাউকে কিছু না বলে গায়ে জ্বর নিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ তোমাদের বাসার কাছে আসতেই মনে পড়লো কয়েকদিন আগে যখন তোমার জ্বর হয়েছিল তখন তোমার মা তোমাকে অনেক আদর করেছিল।
– তোমার মা তোমাকে আদর করে না?
– মাকে কোথায় পাবো? আমরা সবাই তে যে যার মতো বনে বাঁদাড়ে, গাছে, পুকুরে, ডোবায় থাকি। তো হঠাৎ যখন দেখি রাতে জ্বরের কাঁপুণি বেড়ে গেছে তখন মনে পড়লো তোমার মা তোমার গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়েছে। কোলে নিয়ে তোমাকে স্যুপ খাইয়েছে। সেটা মনে পড়তেই টুপ করে তোমাদের বাসায়- একদম কাঁথার ভেতরে ঢুকে পড়েছি।
-খুব ভালো কথা। এখন কি তোমাকে কম্বল গায়ে দিয়ে দেবো?
-তাহলে তো খুবই ভালো হয়।
বাপন আলমিরা থেকে কম্বল বের করে ভুতোর গায়ে দিয়ে দেয়। ভুতোর খুব আরাম লাগে।
-ধন্যবাদ বন্ধু। এখন থেকে আমরা দুইজন বন্ধু। বলে ভুতো হাত বাড়িয়ে দেয়। বাপনও হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে সে আরেকবার লাফিয়ে উঠে। মনে হচ্ছে যেন জলন্ত চুলোর ভেতরে তার হাত পড়েছে। সে তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নেয়।
-ঠিক আছে। এখন ঘুমাও। মাকে ডাকবো?
– কেন?
– তোমাকে স্যুপ করে দেওয়ার জন্য।
-মাথা খারাপ! তোমার মা আমাকে দেখলে পিটিয়ে বের করে দেবে।
-আমার মা! তোমাকে দেখে তো ফিট হয়ে যাবে? তুমি জানো না আমাদের কাছে ভূত কত ভয়ংকর। ছোটবেলা তো মা আমাকে ভূতের ভয় দেখিয়েই ভাত খাওয়াতো, ঘুম পাড়াতো। আর তুমি জানো না আমার মা যে কী ভীতু! সে তেলাপোকা দেখলেও চিৎকার করে সারা ঘর মাথায় তুলে।
-তাহলে আর ডেকে লাভ নেই। আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমুতে দাও। বলেই ভুতো কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাপনও কাঁথা গায়ে দিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ে। তবে একটু দুরত্ব রেখে। কারণ ভুতোর গায়ের গরমে মনে হচ্ছে তার শরীর পুড়ে যাবে। সে শুয়ে শুয়ে ভাবে ভালোই হলো। শেষ পর্যন্ত ভূতের বাচ্চার সাথে বন্ধুত্ব। সকালে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলা যাবে। মাকেও ভুতোর কথা বলে চমকে দেওয়া যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয় ভুতো যদি সত্যিই ভূতের বাচ্চা হয় তাহলে তো রাতে ঘুমের ভেতরে তার ঘাড় মটকে দিয়ে চলে যেতে পারে। সেই ভয়ে তার ঘুম হয় না। সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকে।