ভাড়া বাড়ার আতঙ্কে ভাড়াটিয়ারা

কড়া নাড়ছে নতুন বছর

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ

বাড়ছে বাড়ি ভাড়া, বাড়ছে না আয়। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে নগরীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ শঙ্কায় থাকেন, এই বুঝি বাড়িওয়ালা কোনো না কোনো অজুহাতে বাসা ছেড়ে দিতে বললেন অথবা সামনের মাস থেকে ভাড়া হাজার দুয়েক বাড়িয়ে দিতে বললেন। অস্বাভাবিকহারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই যেন। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে না থাকায় আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে জীবন নির্বাহে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। ভাড়াটিয়ার অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং বাড়িওয়ালাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই।

অভিযোগ রয়েছে, ভাড়াটিয়া বাছাই করতে গিয়ে বাড়িওয়ালা যতটা নাক উঁচু করেন, কোরবানির হাটে গরু কিনতে গিয়েও মানুষ অতটা বাড়াবাড়ি করে না। কেউ ব্যাচেলর ভাড়া দেন না, কেউবা বাচ্চাকাচ্চা থাকা পছন্দ করেন না। কেউ হিন্দু ভাড়াটিয়া ছাড়া দেন না, কারো বা বড়ুয়াতেই আস্থা। এছাড়া ভাড়াটিয়ার পেশাটাও বাড়িওয়ালার মনমতো হওয়া চাই। ভাড়াটিয়া সাংবাদিক হলে ভাড়া বাড়ালে নিউজ করে দিতে পারে, পুলিশ হলে ধরে নিয়ে যেতে পারে, আইনজীবী হলে মামলা করে দিতে পারে, শিক্ষক হলে সর্বক্ষণ ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা থাকতে পারে, রাজনীতিবিদ হলে উপর মহলে পরিচয় থাকতে পারেইত্যাদি শত সহস্র ওজর আপত্তি ডিঙিয়ে যদিওবা বাড়ির মালিকের কৃপা হয়, পরমুহূর্তে এ্যাডভান্সের টাকার অংক শুনে ভাড়াটিয়ার চোখে সর্ষে ফুল ফুটে। আইনে দুই মাসের ভাড়ার সমান টাকা অ্যাডভান্স হিসেবে নেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু বাড়িওয়ালাকে সে নিয়ম মানতে বাধ্য করবে কে? সব সামলে, অন্যদিকের খরচ ছেঁটে অর্থের সংকুলান করে নতুন বাসায় উঠতেই শুরু হয় নতুন সমস্যা। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার ঝগড়ার কিছু সাধারণ বিষয় থাকে। যেমন, বাড়িওয়ালা কর্তৃক যখন তখন বেহিসেবি ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহএমন খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে বাড়িওয়ালার তিক্ত আচরণ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জরিপ মতে, নগরীতে বসবাসরতদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। অভিযোগে জানা যায়, প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাড়ির মালিকরা বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে নগরীতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে ভাড়াটিয়াদের সম্পূর্ণ রূপে বাড়ির মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে অনেক বাড়ির মালিক বাড়িভাড়া থেকে আয় কম দেখিয়ে সিটি কর্পোরেশনের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এছাড়া বাড়ি নির্মাণের পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও বাড়ি তৈরির সময় মালিক রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। অন্যদিকে ভাড়া দাবি করার ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা থাকেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকেন, সাথে শর্ত জুড়ে দেন গোটা পাঁচ/ছয়। মানতে পারলে আসেন, নয়তো আগে বাড়েন। বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে অগ্রিম দিতে হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু কতো তা জানা নেই কারো। সবই বাড়িওয়ালার মর্জি মাফিক। বিশেষ করে যোগাযোগ সুবিধা সম্বলিত বাসাগুলোর ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জামালখান, হেমসেন লেইন, আন্দরকিল্লা, পাথরঘাটা, এনায়েতবাজার, লালখান বাজার, চন্দনপুরা, চকবাজার, মুরাদপুর, নাসিরাবাদ, আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিং, সল্টগোলা, ইপিজেড এলাকায় বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন নামে আইনটি ১৯৪৩ সালে প্রণয়ন করা হয় এ উপমহাদেশে। পরবর্তীতে পূর্ববাংলায় ১৯৫৩ সালে আইনটি প্রণীত হয়।

বাংলাদেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রণয়ন করা হয় ১৯৯১ সালে। আইন আছে ঠিকই, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নগরীতে বাড়ির মালিকদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে ভাড়াটিয়ারা। নিয়ন্ত্রণহীণ বাড়িভাড়া বিরোধী নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক সিনিয়র সাংবাদিক রমেন দাশগুপ্ত বাড়িভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দাবি জানান। আজাদীর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের কাছে বছরে দুইবার ভাড়া বাড়ানোর অনেক তথ্য প্রমাণ আছে। বাড়িভাড়া সংক্রান্ত যে আইন আছে, তা কঠোর নয়। এক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, মানসম্মত ভাড়া প্রসঙ্গে আইনে বলা হয়েছে ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ এ বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না [ধারা ১৫ ()]। যদি বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া নেন তাহলে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ জরিমানা তাকে গুণতে হবে। এরপরও যদি অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হয়, তাহলে প্রতিবার বাড়িওয়ালাকে আদায়কৃত টাকার তিনগুণ জরিমানা দিতে হবে। অগ্রিম হিসেবে এক মাসের ভাড়ার টাকার অতিরিক্ত নেয়া যাবে না। অগ্রিম ও মাসিক ভাড়া ছাড়া যেকোনো ধরনের জামানত নেয়া নিষিদ্ধ। বাড়িওয়ালা অবশ্যই ভাড়াটিয়াকে রসিদ দিতে বাধ্য থাকবেন এবং রসিদে তার স্বাক্ষর থাকতে হবে। প্রতি মাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। লিখিত চুক্তি অনুযায়ী অন্য কোনো তারিখ নির্ধারিত হলে সেই তারিখের মধ্যেই ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ না করা হলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে। আইন সম্মত ও চুক্তি মোতাবেক ভাড়া দেয়া হলে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ভাড়া নিয়ন্ত্রক এরূপ ক্ষেত্রে উচ্ছেদের জন্য কোনো ডিক্রি জারি করবেন না।

নতুন চাকরি নিয়ে ব্যাচেলর থাকা ব্যাংক কর্মকর্তা ইসতিয়াক মাহমুদ জানালেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। পাথরঘাটা এলাকায় রীতিমতো চুক্তি করে তিনি বাড়ি ভাড়া নেন। এ্যাডভান্স ৩০ হাজার টাকা। ৬ হাজার টাকা ভাড়া। প্রথম মাসের ভাড়া দিতে গিয়েই লাগলো গোল। বাড়িওয়ালা ভাড়ার রসিদ দেবেন না। ইসতিয়াকও নাছোড়বান্দা, রসিদ না দিলে তিনিও ভাড়া দেবেন না। দ্বিতীয় সমস্যা বিদ্যুৎ বিলের কাগজ দেবে না। ভাড়াটিয়ার সিদ্ধান্তও একই রকম। এভাবে ছয় মাস চললো। পরে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তিনি বাসা ছেড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত বাড়িওয়ালাকে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ দিতে বাধ্য করলেও ভাড়ার রসিদ পাননি।

বাকলিয়া বউবাজার এলাকায় ১৮০০ টাকা দিয়ে একটা রুম ভাড়া করে থাকেন তিন গার্মেন্টস কর্মী রূপা, আয়েশা ও বিউটি। প্রত্যেকে ৬০০ টাকা করে দেন। নতুন বছর আসার আগেই তাদের মধ্যে ভয় ঢুকেছে; কারণ বাড়িওয়ালা ঘর ছেড়ে দিতে বলেছে। তার নাকি ঘর লাগবে। এ সময় মেয়েরা একাকি থাকতে গেলে নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। অভিভাবকের খোঁজ করে বাড়ির মালিক। রূপা বলেন, ‘গার্জন কইতেই হেরা বুজে বাপ বা স্বামী। না থাকলি সন্দ করে। মনে করে আমরা খারাপ।’ রূপার কথার সূত্র ধরে আয়েশা বলেন, ‘কতা আচে পুলিশের চখে লজ্জা শরম নাই। আমি কই বাড়িঅলাগো চখই নাই।’

পাহাড়তলী আমবাগান এলাকার বাসিন্দা শওকত আলী অভিযোগ করেন এ বাসায় তিনি এসেছেন বছর পেরুতে চললো। কথা ছিল দুবছরের আগে ভাড়া বাড়ানো হবে না। কিন্তু চলতি ডিসেম্বর মাসে বাড়িওয়ালা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন জানুয়ারি থেকে ভাড়া এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ সবকিছুর দাম বেড়েছে। ভাড়া বাড়িয়ে না দিলে কিছুতেই পোষানো যাবে না। মেয়ের স্কুল কাছে, এ জন্য বাসাটি ছাড়তেও পারছেন না তিনি। আবার বাড়িওয়ালার অন্যায় আবদার মেনে নিতেও মন সায় দিচ্ছে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা আইন বানাতে ওস্তাদ। সে আইন লোকে মানছে কিনা তা মনিটরিং করার মানুষ নেই।

কিন্তু মুদ্রার অন্যপীঠও আছে। সে কথা জানালেন শিক্ষক পীযুষ সেন। জয়নাব কলোনিতে তিনি ভাড়া থাকেন স্পরিবারে। বাড়িওয়ালার সাথে তার চুক্তি ছিল দুই বছরের মধ্যে ভাড়া বাড়ানো হবে না। পরবর্তীতে ১০% হারে ভাড়া বাড়বে। তিনি আরো জানান, ভাড়ার রসিদ ও বিদ্যুৎ বিলের কপি দেয়া হয় তাদের। শুধু তাই নয়, বিল পরিশোধ করার পর তার ফটোকপিও ভাড়াটিয়াদের সরবরাহ করা হয়।

পাহাড়তলী আমবাগান এলাকার একটি বাড়ির মালিক আব্দুস সাত্তার। মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা বাড়ি ভাড়া পান। তবে এর বড় একটি অংশই ইউটিলিটি বিল চলে যায়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঋণের কিস্তি। তিনি আজাদীকে জানান, গত নভেম্বর মাসে তিনটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছিল। সেগুলো আর ভাড়া হয়নি। এর মধ্যে আগামী মাসে আরও এক ভাড়াটিয়া চলে যাবেন। এই মাসে তিন মাসের বিল পরিশোধ করেছি। জানুয়ারিতে কী করবো জানি না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির অন্য শরিকরা এবার হল ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’
পরবর্তী নিবন্ধ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’ চিরকূট লিখে গৃহবধূর আত্মহত্যা