আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে বিংশ শতকে। অন্য কথায় ষোড়শ শতক থেকে পুঁজিবাদী বিকাশে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। পূঁজিবাদ যতই শক্তিশালী হয়েছে ততই রাজা নামক এক ব্যক্তির বাইরে ধনীক শ্রেণী তথা বড় লোকরা ক্ষমতার অংশীদারত্ব চাইলো। আত্মপ্রকাশ করলো নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার। বৃটেন সংসদীয় গণতন্ত্র ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পথিকৃত। রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে পার্থক্য ক্রমশ পৃথক হতে থাকল। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট। শাসন কাঠামোর নিয়ন্ত্রকের নাম সরকার। যে জনপদে রাষ্ট্র প্রধান বা রাজা সরকারের অবস্থান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে সে জনপদ বা রাষ্ট্র ততই গণতান্ত্রিক। ভারত, বৃটেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এর ভাল উদাহরণ। আবার রাষ্ট্র ও সরকার যখন এক ব্যক্তি বা ঐ ব্যক্তির দল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, তখনো রাষ্ট্র কল্যাণমূলক হতে পারে। আমেরিকা এবং জার্মানী এর ভাল উদাহরণ। দুটোই কল্যাণকর রাষ্ট্র।
বুর্জোয়া রাষ্ট্র বিকশিত হবার কয়েকটি উপদানের মধ্যে সব’চে বলিষ্ঠ উপাদানটির নাম ভাষা। ভাষা ভিত্তিক জাতি ও জাতি রাষ্ট্র। পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কয়েক প্রকারের রাষ্ট্রের মধ্যে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের সাফল্য ঈর্ষণীয়। টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরে অবতরনের পূর্ব পর্যন্ত সত্যিই জাপান নিয়ে আমার নিজেরও স্পষ্ট ধারণা ছিল। কয়েক দিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বুঝলাম জাপানী ভাষা ঐক্যবদ্ধ করেছে সিন্তো ও বৌদ্ধধর্মে বিভক্ত জাপানী জাতিসত্তা। সাম্রাজ্যবাদী এই রাষ্ট্রটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একরকম মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ মাত্র দু’শকের ব্যবধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পৌঁছে গেছে পৃথিবীর শীর্ষে। জাপানী ভাষা জন্ম দিয়েছে জাতিসত্তার। পরিচয় একটাই আমরা জাপানী। দুধসাদা গায়ের রং, চোখের আকার, চুলের ধরন, মঙ্গোলয়েড মুখোমন্ডল, জাতিটিকে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে রেখেছে। জাপান জাতিসত্তাই জাপান নামক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্বেও ষাটের দশক থেকে মাত্র চার দশকে দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর শীর্ষ দশটি দেশের একটি। একই ভাষাভাষি হওয়া সত্বেও উত্তর কোরিয়া সমাজতন্ত্রের নাম স্বৈরতন্ত্র চালু করে পিছিয়ে আছে অন্তত এক শতাব্দী। অথচ দক্ষিণ কোরিয়ানরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তিকে করায়ত্ত্ব করে এগিয়েছে দুর্দান্ত গতিতে। দেশটিতে বেশীরভাগ মানুষ ধর্ম বিশ্বাসী না হওয়া সত্বেও, এক দুর্দান্ত নৈতিকতা তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। কঠোর পরিশ্রম আর সত্যবাদীতা কোরিয়ানদের নৈতিক ভিত্তি। লালচে গায়ের রং, দীর্ঘকায় দৈহিক গড়ন, বিশেষ ধরনের চোখ ও চুল, প্রাকৃতিক পশু পাখি পোকা মাকড়ের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত কোরিয়ানরা ফুল প্রিয় এক জাতি। ইনসিয়ন বিমানবন্দর থেকে সিউল শহর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে গড়ে তোলা ফুলের বাগান জানান দেয় এরা শুভ্রতার পূজারী। ধর্মের পূজারী না হয়েও একটা জাতি একবিন্দু মিথ্যা বলে না। মিথ্যা কোরিয়ানদের ডিকশনারীতে নেই। দেশটি ভাষা ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
জার্মানীর কথা যথ কম বলা যায় ততই যেন সব বলা হয়। এখনো তারা নিজেদের এরিয়ান বা গর্বিত আর্য জাতি মনে করে। এখনো তারা মনে করে জার্মানরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। গোটা জার্মানী যেন এক অরন্য। প্রকৃতিকে এক বিন্দু বিরক্ত না করে গড়ে তোলা হয়েছে আজকের জার্মানী। জার্মান ভাষা ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের নাম জার্মানী। শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে জার্মানরাই এখনো পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশ। এঞ্জেলা মার্কেলের শহর হামবুর্গ বিমান বন্দর থেকে সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবার মূহূর্ত্বে ভাবছিলাম, ইস্পাত কঠিন এক শৃঙ্খলার এক জনপদ পেছনে ফেলে যাচ্ছি। অনেক ঘুরেছি, অনেক দেখেছি, তবুও যেন দেখার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল।
উপমহাদেশে বঙ্গ তেমনি এক ঐতিহ্যের জনপদ। পশ্চিম বঙ্গের কথা একপাশে রেখে বলা চলে ভাষা ভিত্তিক জাতিসত্তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বাংলাদেশ। বাংলা ভাষা এর প্রাণ, বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর ঈর্ষণীয় সাহিত্য উপজাতীসহ ১৮ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। যেমনটা বলে জার্মান, জাপান কোরিয়ানরা। এরপরও আমার দেশটি এখনো অনেক কিছুই অর্জন করতে পারেনি। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দৈহিক গড়ন, দৈহিক রং, মুখমন্ডল, চোখ, চুল, খাদ্যাভ্যাস প্রায় এক। পোশাক, সংস্কৃতি, লোকগাথা, নৃত্য এক ও অভিন্ন। কারণ একটাই এই জনপদের ভাষা বাংলা ও একক জাতিসত্তা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। বাংলা ও বাঙালিত্ব বহুমাত্রিক বা বহুভাষায়, বহু সংস্কৃতিতে বিভক্ত হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিবর্তন স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
বিগত দু’দশক ধরে অর্জিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে দলমত নির্বিশেষে উচ্ছ্বসিত। এর মূল কারণ ভাষাভিত্তিক এই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রবহমান সামাজিক ঐক্য। দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে হবে, এমন একটি স্পৃহা নতুন প্রজন্মের অন্তরে সদা প্রবহমান। সম্ভবত পৃথিবীর এমন কোন প্রান্ত নেই, যেখানে বাঙালির দেখা মিলবে না। গোটা পৃথিবী থেকে যুব সমাজ দেশে টাকা পাঠায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই।
এরপরও বলা চলে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ঘটেনি। একেবারে ভেতরের কারণ হলো শিক্ষা বিজ্ঞান প্রযুক্তি আত্মস্থকরণে ও বাংলার সর্বজনীন ব্যবহারে আংশিক ব্যর্থতা। অবশ্য প্রশাসনে বাংলা ব্যবহারে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। নিম্ন আদালতেও বাংলা ব্যবহারে সাফল্য প্রচুর। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় বাংলাকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। চর্চা হচ্ছে তবে তা ধীর গতিতে। এই গতি আরো দ্রুত করতে হবে। জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার পূর্ব শর্তই হলো জাতির ভাষাকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়া। ধারণা করা হয় বৈদেশিক মুদ্রার পাহাড় জমলে হবে না। এই অর্থ কাজে লাগাতে প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটাতে হবে। এরজন্য চাই মাতৃভাষাকে মনের গভীরে না রেখে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, দু’তিন দশকের ব্যবধানে বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করেই এই জাতি উন্নত দেশের কাতারে ঢুকে যাবে, হয়তো আমরা সবকিছু দেখে যেতে পারব না। পরবর্তী প্রজন্ম অবশ্যই এই ভূ-খণ্ডকে নিয়ে যাবে জার্মান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার কাতারে।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট