ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি চট্টগ্রামের নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। ভাষা–আন্দোলনের সময়ও নারীদের অংশগ্রহণ এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৬ সালের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় পর্যন্ত চট্টগ্রামের নারীরা ভাষা–আন্দোলনের জন্য জনমত গঠন, পোস্টার তৈরি করা ও লাগানো, প্রচার–প্রচারণা, মিটিং, মিছিল প্রভৃতি কাজে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে বেগবান করেছে। ভাষা আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা বিশেষ করে ছাত্রীরাও রাজপথে নেমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এর পূর্বে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে এরকম ব্যাপকহারে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দৃষ্টিগোচর হয়নি। এদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে এটি ছিল নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তৎকালীন রক্ষণশীল সামাজিক পটভূমিতে ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লেখনী প্রচেষ্টার মাধ্যমে শুরু হয় নারীদের আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ।
১৯৪৭ সালে ‘সীমান্ত’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা মাহবুব আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরীর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। তখন থেকে সীমান্ত পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সকল প্রগতিশীল আন্দোলন এগিয়ে যায়। মাহবুব আলম চৌধুরী পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংখ্যায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সম্পাদকীয় ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে ভাষার প্রশ্নে চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালে প্রদেশব্যাপী আহুত হরতালকে সফল করার জন্য চট্টগ্রামেও তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা জোরদার করার লক্ষ্যে প্রগতিশীল সংগঠন ‘সাংস্কৃতিক পরিষদ’ ও ‘প্রান্তিক’ এর উদ্যোগে ১৯৫১ সালের ১৬–১৮ মার্চ চট্টগ্রামের হরিখোলা মাঠে এক সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রায় ১০০ মেয়েকে সচেতন করে তোলা হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকে সফল করার জন্য মিছিল–মিটিং এ অংশগ্রহণের সাথে সাথে আন্দোলনের জন্য কর্মী সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন কওে পূর্ব বাংলার নারী নেতৃত্ব। তাঁরা বিভিন্ন স্কুল–কলেজে গিয়ে আন্দোলনের পক্ষে ছাত্র–ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেন। আন্দোলনকে সফল করার জন্য নারীবৃন্দ প্রচার–প্রচারণা, পোস্টার লিখন প্রভৃতি কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এক সভায় মাহবুবুল আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক, চৌধুরী হারুন অর রশীদ ও এম এ আজিজকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ‘চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, মিছিল এবং লালদিঘী ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাতদিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়। মিরা সেন, জাহানারা রহমান, জওশন আরা রহমান, হোসনে আরা মাক্ষী প্রমুখ চট্টগ্রামে পোস্টার লেখা ও লাগানোর কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, ‘আমি পোস্টার লিখতে পারতাম না। আন্যরা যেগুলো লিখত তা দেয়ালে দেয়ালে লাগাতাম। মিটিং মিছিলে বক্তৃতা দিতাম। এভাবেই চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগঠন করি।’ ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পূর্ণ হরতাল পারিত হয়। শহরের সমস্ত দোকানপাট, যানবাহন, সরকারি অফিস–আদালত, স্কুল–কলেজ বন্ধ ছিল। চট্টগ্রামের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালে অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলনে মেয়েরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তখন মেয়েদের বাস্তায় বের হয়ে মিছিল করা ছিল অকল্পনীয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র–জনতা শহিদ হওয়ার পর মাহবুবুল আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একুশের প্রথম কবিতা রচনা করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি লালদিঘী ময়দানের জনসভার পর রাতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ একটি বৈঠকে মিলিত হন। ঢাকার আন্দোলনের সাথে সঙ্গতি রেখে আন্দোলন অব্যাহত রাখা এবং ২২, ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ, হরতাল, জনসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মিছিল ও স্লোগানের নগরীতে পরিণত হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘নুরুল আমীনের রক্ত চাই’, ‘নাজিমুদ্দীন গদি ছাড়’ প্রভৃতি স্লোগান দেয়। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদের নেতা এজহার, মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে সেদিন একটি প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ডা. খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রীরা হালিমা খাতুনের নেতৃত্বে মিছিলে অংশ নেয়। মিছিলটি অপর্নাচরণ গার্লস কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে আরও কিছু ছাত্রী মিছিলে অংশগ্রহণ করে। একটি ট্রাকে মেয়েদের উঠিয়ে দিয়ে অন্যরা সাইকেল চেপে বা পায়ে হেটে মিছিলটি চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি অসংখ্য শোক মিছিল চট্টগ্রাম নগরী প্রদক্ষিণ করে। ২৪ ফেব্রুয়ারির হরতাল সফল করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় চট্টগ্রামে। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে চোঙ্গা দিয়ে মিছিল সহকারে প্রচার কাজ চলে এবং পাশাপাশি প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। মেয়েরাও এসব প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে। তাঁরা চোঙ্গা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রচার করেন এবং আন্দোলকে সফল করার জন্য চাঁদাও সংগ্রহ করেন।
২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের পর চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন থানায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল, ধর্মঘট পালিত হয়। বিশেষ করে সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ডু, নাজিরহাট, ফটিকছড়ি প্রভৃতি স্থানে হরতাল ও ধর্মঘট পালিত হয়। জেলার বিভিন্ন শহর থেকে স্কুল–কলেজের ছাত্র–ছাত্রীরা এসে মিছিলে অংশ নেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রতিভা মুৎসুদ্দি, তালেয়া রহমান প্রমুখ ছাত্রীর একটি মিছিল নিয়ে ডা. খাস্তগীর স্কুলে আসেন। সেখান থেকে জওশন আরা রহমান, হালিমা খাতুনসহ অন্যান্যরা মিছিলে যোগ দেন। এরপর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরাও যোগ দেন। মিছিলকারী ছাত্রীরা ট্রাকে করে চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করেন। পরে এক সমাবেশে ছাত্রীরা ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবি করেন। গণপরিষদ কর্তৃক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তালেয়া রহমান বলেন, ‘আমাদের সময়টা খুবই অন্যরকম ছিল। আমরা পুরুষদের থেকে অন্যরকম, অন্যভাবে চিন্তা করি, এমন ধারণাই ছিল না। যারাই গিয়েছে তারাই পুরুষদের সাথে সমানে সমানে গিয়েছে।’ ২৬ ফেব্রুয়ারিও চট্টগ্রাম শহরে হরতাল পালিত হয়। হাটহাজারী, নাজিরহাট, পটিয়া ও অন্যান্য স্থানের ছাত্র–ছাত্রীরা বাস ও ট্রেনযোগে শহরে এসে মিছিলে যোগ দেয়। লালদিঘী ময়দানে সেদিন গণজমায়েত হয়েছিল। ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সভা–সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে হরতাল পালিত হয়। সেদিন চট্টগ্রামের সকল স্কুল–কলেজের ছাত্র–ছাত্রীরা খালি পায়ে এক মিছিল বের করে। মিছিলে ‘মন্ত্রীসভার পদত্যাগ চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দেয়। বিকলে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থীর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভাষা আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলনটি সামগ্রিকতা পায়। কারণ পূর্ব বাংলার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ছিলেন নারী। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা সুদৃঢ় হয়। এই আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা, পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভাষা আন্দোলনে নারীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাঙালি নারীদের অগ্রগতি ও প্রগতিশীলতার প্রথম সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক; শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।