আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, জাতীয় পতাকা অবমননার প্রতিবাদে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে পদযাত্রা করে বিএনপি সমর্থক তিন সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হওয়া এই পদযাত্রায় তিন সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন। নয়া পল্টনে ট্রাকে স্থায়ী মঞ্চ থেকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। সমাবেশে যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্না বলেন, আমাদের এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে ভারতের উগ্রবাদী শাসকগোষ্ঠী যে আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে নিয়ে, আমরা তার প্রতিবাদ জানাতেই এই কর্মসূচি নিয়েছি। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, এসব করে কোনো লাভ হবে না। এদেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। এতে রক্ষার জন্য আমরাও সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
পদযাত্রায় তিন সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের কেন্দ্রীয় নেতারাও অংশ নেন। পদযাত্রাটি শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক মোড়, রামপুরা হয়ে বারিধারায় ভারতের হাইকমিশনে যাওয়ার কথা ছিল। তবে রামপুরা ব্রিজে আটকে দেয় পুলিশ। পরে পুলিশের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে ছয়জন স্মারকলিপি দিতে দূতাবাসে যান। পুলিশের গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার রাকিব হাসান বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে পদযাত্রাটি রামপুরা ব্রিজে আটকে দেওয়া হয়েছে। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি দলকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আমরা ছয়জন প্রতিনিধিকে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নয়ন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী ও সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। এর আগে এ কর্মসূচি ঘিরে ভারতীয় হাইকমিশন এলাকায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি : বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপির তিন অঙ্গ সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। গতকাল বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনে এ স্মারকলিপি দেয় ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল।
স্মারকলিপিতে বিষয় হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, ‘সাম্প্রতিক অবন্ধুসুলভ ঘটনাবলি নিয়ে গভীর উদ্বেগ’। এতে লেখা রয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আমরা এই মর্মে গভীর উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করছি যে, দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র–জনতার অভাবনীয় তুমুল আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা আপনার দেশে পালিয়ে যাওয়ার পর আপনারা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন।
পরে আপনার দেশের অতি উগ্রবাদী নেতারা এবং বিশেষ করে কিছু সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়া বাংলাদেশের এই গণশত্রু হাসিনা ওয়াজেদকে পুনরায় পুনর্বাসন এবং বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অস্থিতিশীল করার জন্য একের পর এক অজ্ঞ–অর্বাচীনের মতো কাজ করে যাচ্ছে, যাতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের বন্ধুত্ব ছিল হাসিনার সঙ্গে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়।
স্মারকলিপিতে লেখা রয়েছে, হাসিনা এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠেছেন। একদিকে তিনি বাংলাদেশের ভিন্ন দলমতের মানুষদের ঘরবাড়ি সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেয়ার হুকুম দিচ্ছেন, অন্যদিকে যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তাদের হত্যা করার হুমকি দিচ্ছেন। ভারতের নিরাপদে আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার এই অপচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না।
আপনি জানেন, গত ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হয়েছে। নৈতিক পদস্খলনের কারণে ইসকন থেকে বহিষ্কৃত সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হাজার হাজার মানুষ যখন রাষ্ট্রীয় মদদ ও প্রশ্রয়ে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা করছিল, তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে আপনার দেশের আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রাপ্ত বিবরণগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রধান ফটক ভেঙে বিক্ষোভকারীদের প্রাঙ্গণে আক্রমণ করার সম্মতি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে তারা জাতীয় পতাকার খুঁটি ভাঙচুর করে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে এবং সহকারী হাইকমিশনের অভ্যন্তরে সম্পত্তিরও ক্ষতি করে।
দুঃখজনকভাবে, প্রাঙ্গণ রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় না থাকতে দেখা যায়। এটি কূটনৈতিক নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন। একইসঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬১ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমন ন্যক্কারজনক বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেও আপনার সরকারের নীরবতায় বাংলাদেশের জনগণ হতাশ। আমরা পরস্পরের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল। আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হবে সমতা, পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস এবং সম্মান প্রদর্শনের ওপর ভিত্তি করে।
এতে আরও লেখা রয়েছে, সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল। ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবজ্ঞাস্বরূপ বলে আমরা চাই, ভারত সরকার ভারতীয় মিডিয়া আউটলেটগুলোকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার আদর্শ প্রচার করতে পরামর্শ দেবে।
আমরা আশা করি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, অপতথ্য বন্ধ করতে ভারতীয় সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দেশগুলোর মধ্যে একটি স্থিতিশীল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ অংশীদারত্ব অপরিহার্য। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জাতিসংঘ সনদের নীতির ওপর ভিত্তি করে সব সদস্যের সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমাদের দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।