আইনস্টাইন খুব সুন্দর কথা বলেছেন : ‘জ্ঞানের চেয়ে চিন্তাশক্তি বড়’। আমার স্বভাবটা খারাপ-সবসময় উল্টো থেকে ভাবার চিন্তা করি। আমি এখন যদি আইনস্টাইনের উপর কথা বলি তা হবে ধৃষ্টতা। কিন্তু কথায় আছে-অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। ঠিক তাই। আমিও সেই ধৃষ্টতার লাইন ধরে বলতে চাই- জ্ঞানের চেয়ে চিন্তাশক্তি নিশ্চয়ই বড়, তবে আপনি আপনার জ্ঞান যত বৃদ্ধি করবেন- ততই আপনার চিন্তাশক্তির পরিধি বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে, অর্থাৎ ২০২০ (বিশ বিশ) বছরের প্রথম ভাগ থেকে, করোনা ভাইরাসের মহামারি বলেন আর অতিমারি বলেন, তা আরম্ভ হয়েছে চীনের উহান প্রদেশের ভাইরাস ল্যাবরেটারি থেকে। এই উহানে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। সেই বছর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা শহরে অনুষ্ঠিত হয় আফ্রো-এশিয়ান জার্নালিস্ট কনফারেন্স। চারদিনের কনফারেন্স শেষে বান্দুং শহরে আমাদের ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন-তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুকার্নো। যিনি ‘বোং কারনো’ নামেও পরিচিত ছিলেন। যার অর্থ- ভাই/ কমরেড ভাই।
সেই নৈশ ভোজে সুকার্নোর সঙ্গে ডিনারে আমরা ছবি তুলেছিলাম। সেই ছবি খুব যত্ন সহকারে বড় করে অ্যালবাম বন্দি করে রেখেছিলাম। কিন্তু কপাল আমার খারাপ, ১৯৯১ সালের ‘টাইডাল বোর’ অর্থাৎ জলোচ্ছ্বাসের সময় আমার বাসভবনের জানালা দিয়ে পানি ঢুকে অন্য দিকে বের হয়ে যায়। তাতে আমার অ্যালবামসহ সম্পূর্ণ ছবি নষ্ট হয়ে যায়।
ডিনারের পর ছিল নাচ গান আর কফির পালা। এই আসর প্রায় ভোর রাত ৩ টা পর্যন্ত চলেছিল। ততক্ষণ পর্যন্ত উনি এক সুন্দরী রমণীর সাথে নেচেছিলেন। আমার তখন মনে হয়েছিল, যে মানুষ ডাচদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতার জন্যে লড়েছেন বলে বার বার বন্দি হয়ে জীবনের স্বর্ণসময় কারাগারে কাটিয়েছেন-বাকী জীবনে একটু আমোদ আহ্লাদ করবেন-নাচবেন-গাইবেন-এইতো স্বাভাবিক।
সেই কনফারেন্সেই চীনা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ আমাদের দাওয়াত দেন চীন সরকারের রাষ্ট্রীয় মেহমান হয়ে চীন সফরের জন্যে। সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের আরও চারজন সাংবাদিক ছিলেন।
যাক সেই কথা। আসি চিন্তাশক্তি আর জ্ঞান প্রসঙ্গে। আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন
আবিষ্কার করেন মধ্যাকর্ষণ শক্তি। নিউটন দেখলেন আপেলটা মাটিতে পড়ল। ফলটা এদিক ওদিক বা উপরে না গিয়ে নিচের দিকে পড়ল কেন? এ প্রশ্ন থেকেই সামনে এলো মহাকর্ষ শক্তির সাধারণ সূত্র। চিন্তা করুন- ক্লাসের সেই ছাত্রটির কথা, যাকে স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন আপেলটি এদিক ওদিক উপরে না গিয়ে নিচে পড়ল কেন? সে উত্তর দিয়েছিল- উপরে খাওয়ার কেউ নেই, তাই স্যার। বলুন ছেলেটি কি ভুল বলেছিল? মোটেও না।
এতক্ষণ ধান ভানতে শিবের গান গাইছিলাম। আসল কথায় আসা যাক। কোভিড-১৯, অতিমারি বা মহামারির কথায় আসা যাক। করোনাকাল আরম্ভ হওয়ার প্রথম ৪/৬ মাস কেউ ঘর থেকে বেরই হয়নি। এমনকি স্বামীকে ঘরে দেখতে দেখতে বউ পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। স্বামীকে শুনিয়ে শুনিয়ে দিনে কয়েকবার তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল-‘এই জ্বালা কখন বিদায় হবে।’ তখন স্বামী বেচারা মনে মনে ভাবছিল- আমাকে বলছে না কোভিডকে বলছে।
এই অতিমারি ও মহামারির মধ্যেই একটি শব্দ লুকিয়ে আছে ‘মরা’। সুতরাং বুঝতেই পারছেন মরতে হবে, হাজারে হাজারে লাখে লাখে। কোভিড শুরু হওয়ার পর চীনের তথা বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ‘আলীবাবা’-এর প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা বলেছিলেন, বিশ সালে বেঁচে থাকাটাই হবে সবচাইতে বড় পাওনা। ভাবি, কত সত্য এ কথা! এত ‘মারির’ মধ্যেই নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে দেখি- সত্যি বেঁচে আছি তো?
আসলে আমরা বাঙালিরা এই অতিমারিতে মোটামুটি ভালভাবেই বেঁচে আছি। আল্লাহর বিশেষ রহমত। এই কোভিডের শুরুতে অনেককেই বলতে শোনা গিয়েছিল, ১৭০০-১৮০০ শতাব্দীর মহামারির মত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে। কিন্তু আল্লাহর কি রহমত তা মোটেও হয়নি? আমরা বাঙালিরা ভালভাবেই বেঁচে আছি।
মধ্যে মধ্যে ভাবি এ কিভাবে সম্ভব? আমার মনে হয়, এটা সম্ভব হয়েছে আমরা বাঙালিরা এক ধরনের ইমিউনিটি (Immunity) ডেভেলপ করেছি-সেজন্য সাধারণ বাঙালি কোভিডের আক্রমণ থেকে বেঁচে আছে। এই ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করলাম কী করে? আমার মনে হয় এর সাথে আমাদের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা সবসময় আমাদের ভেজাল খাদ্য বাজারে দিয়েছেন। আমরা তা পয়সা দিয়ে কিনে গলদকরণ করেছি। আস্তে আস্তে আমাদের পরিপাকতন্ত্র তা মেনে নিয়েছে।
এই যে ওরা আমাদের যা খাওয়ালো তাতে আমরা সবকিছু হজম করার শক্তি সঞ্চয় করলাম। এমনকি কোভিড-১৯ এর জীবাণু পর্যন্ত হজম করে ফেললাম। এও আল্লাহর মেহেরবানী। আমার মনে হয়, আমাদের এই ব্যবসায়ীদের জন্য পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় মিলাদ আর দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা উচিত। যাতে আল্লাহ তাদের দীর্ঘজীবন দিয়ে, আমাদের এইভাবে ভেজাল খাইয়ে আমাদের রোগশোক থেকে দূরে রাখেন। বিশ্বাস করুন, আমরা ভিটামিন পাওয়ার জন্য ফলমূল খেয়ে থাকি। কিন্তু আসলে কী খাচ্ছি? ফরমালিন- যা ফলকে অনেকদিন তাজা রাখে বা নষ্ট হতে দেয় না। ফলমূলে ফরমালিন কী পরিমাণ মিশাতে হবে তার একটা পরিমাপ আছে, সুনির্দিষ্ট মাত্রা আছে। যা আমাদের ওই ব্যবসায়ীরা জানেন বলে মনে হয় না।
এই না জানাই আমাদের জন্য শাপেবর হয়েছে। কারণ কোনো মানুষ যখন খুন হয় তখন মেডিকেলে তার পোস্টমর্টেম হয়। কিভাবে খুন হয়েছে তা জানার জন্যে। পরে যখন মামলা হয় তখন অনেক সময় কোর্টের আদেশে কবর থেকে উঠিয়ে মরদেহের আবার পরীক্ষা করা হয়। বুঝুন ঠেলা। এই ব্যবসায়ীরা যদি ফরমালিন না খাওয়াতো মরদেহের কি অবস্থা হতো? এই ফরমালিন মরা দেহকে অনেক দিন পচতে দেয় না। তাই ডাক্তার ভাইদের কাজ করার কত সুবিধা করে দিয়েছে। আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের এই ব্যবসায়ীদের জন্যে দোয়া করি- যাতে তারা দীর্ঘজীবী হয়ে এভাবে আমাদের সেবা দিয়ে যেতে পারেন।