ভাত-মাছ-কৃষি: ফিরিয়ে আনতে হবে আবার

ফজলুর রহমান | সোমবার , ২৯ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

সামনে লাঙ্গল চষে চলছে। গরু জোড়া টানছে লাঙ্গল। কৃষক চেনা স্বরের হাকডাকে লাঙ্গল ঘুরাচ্ছে। মাটির বুক চিরে তৈরি হচ্ছে চারা বপনের ক্ষেত। আর লাঙ্গলের পেছনে কি? বা কারা? বিশেষ করে পানিতে মাটিতে মাখামাখিকালে। বৃষ্টির মৌসুমটায়।

সামনে লাঙ্গলের ফলা। কিংবা মাটি সমান করার টানা। এই দুটোর কোন একটা চলছে এমন সময়ে। একদল শিশুকিশোরের কাজ পড়তো। মাছ কুড়ানোর কাজ। ছোট মাছ । দেশি মাছ। একেবারে মাটির ঢেলায় লুকানো মাছ। এই যেমন টাকি, শিং, মাগুর, মলা, পুটি, বাইন, কই, পুই ইত্যাদি জাতের।

সে মাছ স্থান পেতো ছোট হাতা, বাটি, জগ কিংবা লুঙ্গির পিটে বা হাফ প্যান্টের পকেটে। দূরন্ত কৈশোরের সংগৃহীত মাছে উঠে যেতো পাতে। কৃষাণী বড় যতনে তা রান্না করতেন। এভাবে একটা চক্র চলতো আউশআমনের দিনে। এতে প্রোটিনের চাহিদা মিটতো। গ্রামীণ স্বাদে বৈচিত্র্য আসতো।

সেই লাঙ্গলের জায়গা দখলে নেয় কলের লাঙ্গল। ট্রাক্টর বলি যারে। ট্রাক্টর যুগের সূচনাতেও এমন মাছের নিমিত্তে সমাগম দেখা যেতো। ধান কাটার পরও জমে থাকা পানিতে মাছেরা উপস্থিতি জানান দিতো। তা আয়েশে ধরে বাড়িতে আনতো কৃষক। এছাড়া বিলের পানিতে কিংবা আইলে চাঁইসহ নানা ফাঁদ বসিয়েও মাছ ধরার কারবার চলতো। এখনো সেই কলের লাঙ্গল আছে। মাছ ধরার নানা ফাঁদও আরো শক্ত রূপ পেয়েছে। কিন্তু মাছ?

সেই মাছ আর নেই। সেইসব দিনও এখন গত। কেন এমন হলো। এক কখায় প্রকাশে বলতে হয়রাসায়নিকের ঘনঘটা। অধিক খাদ্য ফলানোর একটা প্রতিযোগিতা চলে এসেছে। অধিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারও বেড়েছে। বিপরীতে বিলে থাকা মাছের বারোটা বেজে গেছে।

মাছে ভাতে বাঙালি কিংবা ভাতে মাছে বাঙালি দুটোই সত্য কথা। কারণ, আমাদের ভাত ছাড়া চলবে না, আবার মাছ ছাড়াও চলবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো সুদূর চীন দেশে গিয়েও খুঁজে বেড়িয়েছেন মাছভাত। বঙ্গবন্ধু ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইতে তা তুলে ধরেছেন এইভাবে– “বিদেশে একটা বন্ধুকে পেয়ে বড় আনন্দ হলো। ঠিক চারটায় মাহবুব ও তার বিবি উপস্থিত হলো। আমাদের ওর বাসায় খেতে দাওয়াত করলো। আমি ওর স্ত্রীকে বললাম, আপনি যদি ঝাল দিয়া মাছ পাক করে খাওয়ান তবে এক্ষুণি আপনার বাসায় যাবো।”

আসলে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তালিকায় কোন না কোনভাবে জুড়ে ছিল মাছ। গ্রাম বাংলায় বাড়িতে তো বটে বিয়েসহ যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে এই মাছের বেশ কদর থাকতো। আর এখন? এখন দেখা যায়গ্রামই মাছহীন হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন সময় গ্রামে মাছের দাম বরং ঢের বেশি শহরের তুলনায়! এরই মধ্যে দেশি জাতের অনেক মাছ বিলীনও হয়ে গেছে!

বাণিজ্যিক মাছচাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে দেশে। তবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে চেনা স্বাদের দেশি মাছ। কারেন্ট জালসহ নিত্যনতুন পদ্ধতিতে মাছ নিধন, কীট নাশক প্রয়োগে বেপরোয়াভাবে মাছ নিধন, পুকুরদীঘির একাধিক মালিকানাজনিত ভাগবাটোয়ারা, জলাশয় ভরাট করে আবাসন গড়া, জলাশয় দূষণ, নদনদীর নাব্যতা হ্রাস, বাঁধ দিয়ে মৎস্যচাষ, অবাধ ড্রেজিং বাণিজ্য, বিদেশি লাভজনক আগ্রাসি মাছের চাষ প্রভৃতির ফলে দেশি মাছ ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। দেশে মাছ ও ভাতউভয়ের দরকার বাঁচার জন্য, পুষ্টির জন্য। আর তা পূরণে মাছভাত নির্ভর একটা কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। এই ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে সেই পুরোনো ঐতিহ্য আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি।

ভাতমাছকৃষির একটা মডেল এর বিষয়ে একটা গবেষণা প্রতিবেদন দেখেছি গণমাধ্যম মারফত। সেটা থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে বেশ দেখা মিলে। মডেল অনুযায়ী ধান চাষের সময় জমির চারপাশের আইল উচুঁ করে তৈরি করা হয়। এরপর প্রথমে ধান রোপণ করা হয় ১০ ইঞ্চির মতো পানিতে। সঙ্গে কিছু দেশীয় মাছও ছেড়ে দেয়া হয়। ধানের চারা বড় হলে পানির পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়। আর আরো বড় হলে হাতখানেক পানি জমা থাকে মতো ব্যবস্থা করা হয়। ধরা যাক, বর্ষা মৌসুমতখন তো অতিরিক্ত পানি। সেটার ব্যবস্থাও রাখা থাকে। নেট বসিয়ে অতিরিক্ত পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মাছ রয়ে যায়।

ভাতমাছকৃষি মডেলের জমিতে কীটনাশক দেয়া হয়না। গবাধি পশুর উচ্ছিষ্ট বা প্রাকৃতিক কিছু খাবার দেয়া হয়। মাছেরা এমনিতেই ধানী জমিতে ভালো থাকে। বিভিন্ন পোকা, অনুজীব খেয়ে আনন্দে থাকে। এতে ধানের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। ধান কাটার পরপরই মাছও ধরে নেয়া হয়।

এই মডেলে উৎপাদিত মাছে সেই চেনা স্বাদ পাওয়া যায়। কারণ কৃত্রিম খাবারপানি কোনটা এখানে ব্যবহার হয়নি। একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা মাছ মিলছে এই মডেলে। আমরাও চাইলে সেই মডেল অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারি। কয়েকটি সফল মডেল দেখাতে পারলে গ্রামের কৃষি ব্যবস্থায় নতুন বিপ্লব আনা যায়।

এই ভাতমাছকৃষি মডেল আসলে নতুন নয়। একদা আমাদের এই ব্যবস্থা ছিল অন্যভাবে। এই যেমন যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র প্রকাশ করেছেন-‘ভাতমাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’ এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা চাইলে নতুন করে, টেকসই মডেলে সেই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।

লেখক: উপপরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপ্রত্যাশিত ছুটি
পরবর্তী নিবন্ধএম এ মামুন : শিক্ষকতার কিংবদন্তী, সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা