আমরা পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই–কারণ পরিবর্তনই তো এই সংসারের চিরন্তন নিয়ম। নতুন চিন্তা, নতুন পথ, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি–এসবের ভেতর দিয়েই সভ্যতা এগিয়ে যায়। কিন্তু সব পরিবর্তনই উন্নয়নের পথে নিয়ে যায় না। কিছু পরিবর্তন আছে, যেগুলো দেখলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
আজকের শিশুদের দিকে তাকালে, অনেক সময় আমাদের চোখে পড়ে সেই ভাঙন, যেটা কেবল সময়ের দায় নয়–সমাজ ও পরিবার, দুটোরই সমান দায়। শৈশব এখন আর আগের মতো উচ্ছ্বল, নিরাপদ কিংবা নির্ভার নয়। কোনো কিশোরী এখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের মা–বাবার বিরুদ্ধে সুরক্ষা চাইছে, আবার কোনো কিশোর মায়ের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে ভালোবাসা না পাওয়ার অজুহাতে।
মেহরীন আহমেদ, রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী। দেখতে স্বাভাবিক একজন কিশোরী হলেও তার জীবনের অভিজ্ঞতা বড়দের মতো কঠিন, গাঢ় এবং বেদনাবিধুর। সম্প্রতি সে নিজেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে–জানিয়েছে, নিজের মা–বাবার হাত থেকে সুরক্ষা চায় সে।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যখন শুনানি চলে, তখন উপস্থিত ছিলেন তার মা জান্নাতুল ফেরদৌস ও বাবা নাসির আহমেদ। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মেহরীন যখন বলছিল, “আমি তাদের পুতুল নই… আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয়েছে,” তখন তার মা নিশ্চুপ, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর বাবা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মেয়ের চোখে।
মেহরীনের ভাষ্যে উঠে আসে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা–তাকে মানসিক হাসপাতালে আটকে রাখা হয় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। সেই হাসপাতালে সে নাকি বারবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার অভিযোগ–যে ঘরটা তার আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল, সেটাই পরিণত হয়েছে এক কারাগারে। অথচ সে তো শুধু চেয়েছিল একটি স্বাভাবিক জীবন, যেখানে থাকবে একটু শ্রদ্ধা, একটু ভালোবাসা, একটু স্বাধীনতা। তার সেই চাওয়া আজ আদালতের দরজায় এসে ঠেকেছে।
অন্যদিকে একদম ভিন্ন বাস্তবতা, কিন্তু সমান করুণ এক গল্প। নবম শ্রেণির ছাত্রী তমা, বাবা–মায়ের আদরে সন্তান। দুই বোনের মধ্যে তমা সবার ছোট। সচ্ছল পরিবার, ভালোবাসায় মোড়া শৈশব, যা ঘিরে ছিল পছন্দের খাবার, দামি জামাকাপড়, ব্র্যান্ডের মোবাইল, এবং অতিরিক্ত স্বাধীনতা।
তমার জীবনে হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ে এক “ভালোবাসা”–এক কলেজপড়ুয়া ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক, যা মাত্র এক মাসের। কিন্তু তাতেই যেন সে পুরো জীবনের মানে খুঁজে ফেলে। যখন বাবা–মা জানতে পারেন, শুরু হয় বাধা দেওয়া। আর তাতেই তমা ভেঙে পড়ে। কান্নাকাটি করে, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে, হুমকি দেয় আত্মহত্যার–বলতে থাকে, “তমালকে না পেলে আমি মরেই যাবো।”
তমা জানে না ভালোবাসা মানেই পাওয়া নয়, জানে না প্রত্যাখ্যান মানেই ভেঙে পড়া নয়। তার কাছে জীবন মানে এখন এক অলীক কল্পনার মায়া। বাবা–মাও বুঝতে পারেননি–ভালোবাসা কেবল চাওয়াপাওয়ার খেলায় আটকে থাকলে, সন্তানের মন তৈরি হয় না, তৈরি হয় দাবি আর হতাশার এক ভয়াবহ ঘূর্ণি।
এই দুইটি গল্প–মেহরীনের অবহেলা আর তমার অতিরিক্ত স্বাধীনতা–দেখিয়ে দেয়, বিপরীত প্রান্ত থেকে বেড়ে ওঠা শিশুদের শৈশব একইভাবে বিকৃত হয়ে যেতে পারে। একদিকে দমন আর অবজ্ঞা, আরেকদিকে লাগামহীন প্রশ্রয়–দুটিই বিপজ্জনক।
শৈশবের এই বিকৃতি কেবল ঘরের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। আজকের অনেক কিশোরই বিপজ্জনক গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। স্কুলের পর, সন্ধ্যার অন্ধকারে বা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের পরিচয় খোঁজে ‘দলের সদস্য’ হয়ে। সেখানে আছে আধিপত্য, হুমকি, ছুরি, মাদক–কিন্তু নেই মা–বাবার কণ্ঠের স্নেহ, শিক্ষকের চোখের ভরসা, কিংবা সমাজের সঠিক দিশা। এই প্রজন্ম অনেক আগেই বড় হয়ে যেতে চায়। তারা বাবা–মার জুতা পায়ে দিয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায় না, বরং সেই জুতা দিয়েই বাসায় ফুটবল খেলে। তারা শিক্ষকের সামনে হাত জোড় করে মাথা নোয়ায় না, হ্যান্ডশেক করতে এগিয়ে যায়। আধুনিকতার ছোঁয়া এসে ভক্তিকে সরিয়ে দিয়েছে, শিকড় উপড়ে ফেলেছে। এটা কি কেবল সময়ের দায়? না কি আমরা, অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ–সবাই মিলে এই শৈশবটাকে গড়তে গড়তে ভুল করে ফেলছি? না, এই শৈশব এমন হওয়ার কথা ছিল না। শৈশব হোক উচ্ছল, কৌতূহলী, নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খল। যেখানে ভালোবাসার সঙ্গে থাকবে সীমারেখা, স্বাধীনতার পাশে থাকবে দায়িত্ববোধ শেখার সুযোগ। লেখক : প্রাবন্ধিক