ভাঙনের শব্দ শুনি

আরিফ আহমেদ চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১ আগস্ট, ২০২৪ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার আগে দেশে বড় শিল্প গ্রুপগুলোর প্রায় সবাই ছিলো প্রধানত পারিবারিক উদ্যোগ। সে সময় শিল্প খাতে আধিপত্য ছিলো অবাঙালিদের। বাঙালি উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজি গঠন ও বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসা অনেক কঠিন ছিলো। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে ২২টি ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের কথা শোনা যায়। তবে সেই ২২ পরিবারের মধ্যে এ.কে.খান ও ইস্পাহানী পরিবার ছাড়া বেশিরভাগেরই এখন আর ঐ জৌলুশ নেই। স্বাধীনতার পর অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম আদমজী গ্রুপ। স্বাধীনতার পর কর্মনিষ্ঠা, সৃজনশীলতা, সুযোগসুবিধা, দক্ষতা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী ধনী হয়েছেন। জন্ম হয়েছে ধনী পারবারিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশে এখনকার ধনী পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সেই ২২ পরিবারকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এখন কয়েকশ ধনী পরিবারের বসবাস এ দেশে। দেশের বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংগভাগই পারিবারিক ব্যবসা। এই ধনী পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো জাতি গঠন, কর্মসংস্থান ও সম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

দশকে বাংলাদেশের সফলতা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ওষুধ, ব্যাংকিং, টেলিকম, মিডিয়া, ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর দুইতৃতীয়াংশই পারিবারিক ব্যবসা। অনেক ক্ষেত্রে শূন্য থেকে শুরু করলেও বর্তমানে আয় শতকোটি ছাড়িয়েছে এমন অনেক পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও আছে বাংলাদেশে। বেশির ভাগ পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়িয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থেকে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানগুলো। পারিবারিক ব্যবসাগুলোর বিকাশ হয়েছে মূলত প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের দ্বারা। কিন্তু, দেখা যায়, প্রথম প্রজন্মের এই উদ্যোক্তা, যিনি ঐ ব্যবসার মূল সঞ্চালক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, তার মৃত্যু বা অবসরগ্রহণের পর ব্যবসায় ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি, কাঁচামালের বিষয়গুলো। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ব্যবসার কর্তৃত্ব হস্তান্তর। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ব্যবসার কর্তৃত্ব হস্তান্তরের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা, বিবাদ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বোনেরা স্বামীর সংসার নিয়ে বিদেশ থাকেন। তাই, ভাইদের মধ্যে বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। আর এক বা একাধিক ভাই অন্যায়ভাবে বাবামার কাছ থেকে সম্পত্তি নিয়ে নিচ্ছে বা এককভাবে ভোগদখল করতে দেখা গেছে। আবার, বাবামা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকে সম্পত্তি নিয়ে তাদের পথে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। সামপ্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা না থাকার কারণে এবং কর্পোরেট সুশাসন না থাকার কারণে পারিবারিক ব্যবসায় বিরোধ দেখা দিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল উদ্যোক্তাগণ তাদের মৃত্যুর আগে স্বচ্ছ উত্তরাধিকার পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন না। কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরীর ব্যাপারেও অনাগ্রহ পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে পারিবারিক ব্যবসাগুলো কাজ না করার আরেকটি কারণ হলো শক্তিশালী পরিচালনা পর্ষদের অভাব। আসলে, পারিবারিক ব্যবসা প্রসারে পরিবারের সবার প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয়। সবাইকে অনেক আন্তরিক থাকতে হয়। মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি পণ্যের মানের কথা চিন্তা করা প্রয়োজন। ব্যবসা প্রসারে পারিবারিক মূল্যবোধ প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করতে গিয়ে সবার মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি হয় এবং একই রকম মন মানসিকতার সৃষ্টি হয়। তবে, পরিবারের যদি একজন সদস্যেরও এই মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়, তখন ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয়। কিছু ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে হস্তান্তরের পর বিনিয়োগ সমপ্রসারণের ফলস্বরূপ পরিবারের মধ্যে কোন্দল দেখা দিয়েছে। কখনো কখনো তা আদালতেও গড়াচ্ছেউত্তরাধিকারীরা একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করছে। দ্বন্দ্বের মুখে পুরনো প্রতিষ্ঠান ভেঙে তৈরি হচ্ছে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আবার, কিছু ক্ষেত্রে ভাঙ্গনের আগেই গোটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় অংশীদারদের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ছে। সার্বিকভাবে অংশীদারত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠে, তখন আর প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। ব্র্যান্ড ভ্যালু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কর্মকর্তাকর্মচারীরা সংশয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করে। হুমকিতে পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা। ঋণপত্র খোলা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় নথি সই পর্যন্ত অনেককিছু বিলম্বিত হয়। এভাবে যখন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে প্রভাব পড়ে, তখন সমস্যা আরও গভীর হয়ে উঠে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কাজগুলো সময়মতো হয় না।

পরিবারকেন্দ্রিক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে অনেকটা বড় সময় ধরে ব্যাংকিং করে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলিই বিভিন্ন ব্যবসায় ব্যাংকগুলি থেকে বিপুল অংকের ক্রেডিট লোন নিয়ে থাকে। ফলে, পারিবারিক অনৈক্যের কারণে যদি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানের ক্যাশফ্লোতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয় এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ঋণ খেলাপি হওয়ার দিকে প্রতিষ্ঠানটি এগুতে থাকে। সমপ্রতি, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, দেশে এখন মন্দ ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরাসরি খেলাপি ঋণ এক লাখ ৪৫ লাখ ৬৩৩ কোটি টাকা। এই মুহূর্তে পারিবারিক অনৈক্যের কারনে যদি আরও খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়, তা দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী করবে। তাই পারিবারিক অনৈক্য বা বিরোধ যেসব প্রতিষ্ঠানে দেখা দিচ্ছে, তা নিয়ে ব্যাংকারদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

পরিবারের মধ্যে নানা কারণে বিরোধ দেখা দিতে পারে। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সম্পত্তির দেনাপাওনা ু সব বিষয়ে বিরোধ হতে পারে। সামান্য বিরোধেও মামলা করা হয়। মামলা মোকদ্দমায় পথে রয়েছে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা। অথচ, একটু সচেতন হলে এবং আন্তরিক হলে পারিবারিক বিষয়গুলো নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতে পারা যায়। মামলা না করেও আইনি উপায়ে বিরোধের মীমাংসা করা যায়। আবার, মামলামোকদ্দমা হলেও তা চলাকালীন অবস্থায় আপসমীমাংসা করে নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি প্রধানত পরিবারকেন্দ্রিক। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে পরিবারের কর্তাই মূল নিয়ন্ত্রক। তাই, সময় এসেছে টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার। প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে ব্যবসার পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের উত্তরাধিকারীদের জন্য ব্যবসামুখী শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, খুঁটিনাটি বিষয়েরও সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। যেসব কোম্পানি কর্পোরেট স্ট্রাকচারের মধ্যে আসতে পারেনি, পেশাদারদের দিয়ে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেনি, সুশাসন কায়েম করতে পারেনি; সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ অনস্বীকার্য। যতই পারিবারিক ব্যবসা হোক, একটা পর্যায়ে এসে কর্পোরেট স্ট্রাকচার গড়ে তুলতে হয়। যথাযথ যোগ্যতার সঙ্গে অভিজ্ঞতাটাও জরুরি। কর্পোরেট স্ট্রাকচার এমন হওয়া উচিত যাতে প্রতিষ্ঠাতা বা মূল কর্তাব্যক্তির অনুপস্থিতি বা মৃত্যুতেও, অধিষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তাব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠানের মিশন, ভিশন ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। কর্পোরেট স্ট্রাকচার এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে পেশাদারদের অবর্তমানে অথবা পরিবর্তনে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবেই পরিচালিত হয়। ব্যবসার অবশ্যই একটি স্পষ্ট উত্তরাধিকারী পরিকল্পনা থাকতে হবে, যেখানে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। পারিবারিক সম্পদের মূল্যায়ন ও সম্ভাব্য বন্টন সম্পর্কে উল্লেখ থাকা জরুরি। পাশাপাশি, ব্যবসা কিভাবে পরিচালিত হবে বা বিজনেস কন্টিনিউটি প্ল্যান থাকা দরকার। সর্বশেষ কথা, বিভক্তি বা ভাঙন থেকে যদি ভালো কিছু হয় অর্থাৎ নতুন ব্যবসায়ীক উদ্যোগ বা উদ্যোক্তা, নেতৃত্ব তৈরী হয়, তাহলে ভাঙনই ভালো। কিন্তু যে ভাঙন থেকে শুধু ধ্বংস বয়ে আনে, অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, সেক্ষেত্রে তা যে কোনো ভাবে রুখতে হবে, ঐক্য ধরে রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাখির রাজ্য
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় অবৈধ মৎস্য আহরণ বন্ধ করা হোক