ভাইরাল

করবী চৌধুরী | শনিবার , ২৩ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

তথ্য প্রযুক্তির সৌজন্যে আজকাল আমাদের দেশের মানুষ অনেক আপডেট হয়েছে। শহর থেকে শুরু কিরে গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত আবালবৃদ্ধবনিতা সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন, সবার কানে হেডফোন। মনে এবং কানে একরকম কালা বলে আশেপাশের কোন কান্নাহাসি, মানুষের আর্তনাদ কিছুই এদের কানে প্রবেশ করে না। দিনেদিনে মানুষ যত অনলাইন হচ্ছে মানবিকতা ততই অফলাইনে চলে যাচ্ছে। সবাই রিল বানাতে ব্যস্ত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁতব্রাশ করা থেকে রাতে বিছানা ঝেড়ে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত এমন কোন বিষয় নেই যে বিষয়ে এসব টিকটকারেরা রিল বানায় না। কতটা অমানবিক হলে দুর্ভোগে পতিত মানুষকে সাহায্য করা বাদ দিয়ে মানুষ আজ ভিডিও রিল বানাতে ব্যস্ত থাকে। অনলাইনে রোজগারপাতিতে আজ সবাই ব্যস্ত। প্রশংসিত বা নিন্দিতযে কোনভাবেই ভাইরাল হতে চায় সবাই।

ভাইরাল’ শব্দটি একসময় শুধু রোগের সাথেই জড়িত ছিলো। যে রোগ খুব দ্রুত কোন কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে, তাকেই বলা হতো ভাইরাল। আর এখন ‘ভাইরাল’ শব্দের সহজ মানে হলো, ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া কোন কিছু। সেটা হতে পারে গান, হতে পারে কোন ভালো, কিংবা খারাপ ভিডিও। ‘ভাইরাল’ শব্দটা এখন জনজীবনে আগাগোড়া আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রামে ভাইরালকে যেমন দিয়েছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি, তেমনই পাহাড়সম নেতিবাচকতার মাঝেও ব্যবহারকারীরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই ‘ভাইরাল’ শব্দটিকে। ভাইরাল হতে উন্মাদের মতো এখন সবাই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত ভাইরাল হবার জন্য খোঁজে নানান উপায়। অনলাইনের অনেক মিথ্যা ছবি, সংবাদ, ভুল তথ্য.. ভাইরাল হবার কারণে কত মানুষের জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। হঠাৎ কারো কোনো ছবি, ভিডিও, লেখা, অনলাইনে হড়কা বানের মতো প্রচণ্ড গতিতে হয়তো ছুটে গেলো, অর্থাৎ ভাইরাল হয়ে গেলো! বানের তোড়ের মতো ভিউয়াররা যেন ছুটছে তার পিছু। ভালোমন্দ, সত্যমিথ্যা, সমাজের জন্য হিতকর কিংবা অহিতকর, কোন কিচ্ছুর পরোয়া না করে মুহূর্তের মাঝেই হয়তো মিলিয়ন ভিউ হয়ে গেলো। আর এই ধান্ধায় পোস্টদাতার পকেটও ভারী থেকে ভারীতর হতে লাগলো।

বুঝুন অবস্থা!

অনেক সময় স্রোত থেকে বেরিয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নেওয়া কোনো কোনো ভাইরাল বিষয় সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কিছু ভাইরাল বিষয় স্রেফ আনন্দ দিয়ে গেলেও কিছু কিছু মনোকষ্টে কাঁদিয়েও যায়। যে একটা প্রশ্ন আমাদের মনে জাগতেই পারে সেটা হলো, ‘ভাইরাল কবে থেকে ভাইরাল হলো?’ সাধারণভাবে উত্তরটা হলো, ভাইরাল যেহেতু ইন্টারনেটেরই সন্তান, তাই যখন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনপ্রিয় হলো সেদিন থেকেই ‘ভাইরাল’ ভাইরাল হলো। অনলাইনের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো ‘ভাইরাল’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন লেখক সেথ গোডিন। ২০০০ সালের ৩১ জুলাই ‘আনলিশ ইয়োর আইডিয়া ভাইরাস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ উনি লিখেছিলেন ‘ফার্স্ট কোম্পানি ডটকম’ এ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাভ দ্য আইডিয়া বিহাইন্ড ইয়োর অনলাইন এক্সপেরিয়েন্স গো ভাইরাল..”। প্রবন্ধটির কী হয়েছিলো সেটা সঠিক জানা নেই, তবে সেই থেকে ‘ভাইরাল’ শব্দটা কিন্তু ঠিকঠাকভাবেই ভাইরাল হয়ে গেছে। ভাইরাল হতে গিয়ে মানুষ আজ মানবিকতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পথে একসিডেন্ট হলো, পথচারী কাতরাতে লাগলো, কিন্তু সহায়তা করার বদলে আশেপাশের মানুষ মোবাইলে ভিডিও করতে লাগলো! সময় কোথায় এদের?

গরমাগরম সেই ভিডিও ইউটিউবফেসবুকে আপলোড করতে হবে। ভাইরাল হয়ে টাকা কামাতে হবে যে! কতটা ঘৃণ্য আর অমানবিক এইসব মানুষরূপী এই অমানুষগুলো!

ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বর্তমানের মিডিয়াগুলো আবার আরো এককাঠি সরেস এসব ক্ষেত্রে। মনে করুন, কোনো বাইক কিংবা সিএনজি এক্সিডেন্ট হলো। সহায়তার পরিবর্তে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে কার আগে কে যাবে এমন ঠ্যালাঠেলি করে ভিড়ের মাঝে গিয়ে আহত ব্যক্তিদেরকে কখন, কিভাবে একসিডেন্ট হলো, এখন আপনার কেমন লাগছে.. উল্টোপালটা প্রশ্ন করতে থাকে। অথচ আহতদের জন্য তখন প্রয়োজন হলো, তাৎক্ষণিক চিকিৎসা বা সেবার। সেসব ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে না পথচারী, না তামাশা দেখার মানুষ, না এসব খবর সংগ্রাহকেরা কেউই এগিয়ে আসে না। কেউ ভিডিও কন্টেন্ট, আর কেউ কেউ নিউজ কন্টেন্ট করতে ব্যস্ত। কারণ একটাই। ভাইরাল হতে হবে। পুলিশি হাঙ্গামা এড়াতে অনেকে দূর থেকে মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করে। এই হচ্ছে আজকের মানবিকতা। পরিশেষে একটা কথাই শুধু বলা যায়, ইন্টারনেট আমাদের জীবনকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছে মনুষ্যত্ব আর আবেগ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসি মানুষের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে