তুষার প্রথম শ্রেণিতে পড়ে । বাবা প্রতিদিন তাকে ইশকুলে দিয়ে অফিসে চলে যায়। যাওয়ার সময় তুষারের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঠিক এগারোটায় ছুটি হলে মায়ের সাথে বাড়ি ফিরে।
বাড়ি এলে ছোটো ভাই আদর মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তুষারের তখন মন খারাপ হয়ে যায়। একটু মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াতেও পারে না। আদর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে । এ কেমন হিংসুটে ভাই ? দিনে দিনে আদরের আচরণে তুষার একদিন রেগেমেগে বলে ওঠে।
আদর ছি ছি তুই এমন কেন রে তুই ?
আদর বলে, এটা আমার মা, আমার মাকে কেউ ধরবে না। আদরের এমন কথায় মা মুচকি মুচকি হাসলেও তুষার রেগে যায়। তবে কিছু বলে না।
মায়ের সামনে থেকে চলে যায় বারান্দায়। বসে বসে তুষার খেলনাপাতি নিয়ে খেলা করে আপন মনে। হঠাৎ আদর ঘর থেকে বের হয়ে খেলনাপাতি নিয়ে ঘরে আসে। তুষার অবাক হয়ে বসেই থাকে। মেজাজটা এত বিগড়ে যায় তার। তারপরও আদরকে কিছু বলে না তুষার।
এ ভাবে দিন যায় রাত আসে। আদর, আদর পেয়ে পেয়ে বড় বেশি একরোখা হয়ে যায়। ঘরের সব জিনিসপত্র তার। তুষারের কোনো কিছুতে যেন অধিকার নেই।
মাকে বললো মা এতটুকু বলে আদর এখনও ছোটো।
তুষার ভাবে মায়ের কথাই হয়তো ঠিক আদর এখনও ছোটো। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। এই ভাবনা থেকে সবকিছু নীরবে বয়ে যায় তুষার।
আদর এখন ইশকুলে যায়। যতো বড় ততো তার চাহিদাও দিন দিন বড় হতে থাকে। সবকিছুতে তার বড়টা চাইই চাই। বাবা তাদের ইশকুলে যেতে কিছু খাবার কিনে সমান ভাগ করে দেয়। আদর নিজেরটা খাওয়ার আগেই তুষারের খাবারে ভাগ বসায়। একদিন তুষার আদরের ব্যাপারে মাকে বলে মা আদরের কোনো কিছুই আমার ভালো লাগে না । ও আজও আমার খাবার কেড়ে নিয়েছে। মা বলে তাই? এই অভিযোগ ?
না না মা, এভাবে চলতে পারে না। ও কী ভেবেছে? প্রতিদিন আমার সঙ্গে যা করে কোনো সৎ ভাইও এমনটি করে না। আমার সবকিছুতে জোর খাটায়। ওর এত জেদ কীসের? শুধু তোমার আদরে আদরে হয়েছে। নামটাও রেখেছ আদর। আদর না ছাই।
তুষার তুমি আদরের বড় ভাই। এভাবে কথা বলছ কেন?
কীভাবে কথা বলেছি মা? আমি তো ওকে কিছু বলি না। শুধু তোমাকে বলছি। একটু সাবধান করে দিতে ।
একদিন তুষার ভাত খেয়ে যেই না মায়ের আঁচলে মুখটা মুছতে যাবে ঐ সময়ে আদর পেছন থেকে তুষারকে হেঁচকা টানে সরিয়ে দিয়ে মায়ের কোলে উঠে বসলো।
আদর, এই আদর তুই এত বেয়াদব কেন রে?
আদর তুষারের কোনো কথাই শুনতে চায় না।
আরও ভেংচি কাটে।
মা আদরকে কিছু বলে না দেখে তুষার মুখ গোমড়া করে বিছানয় শুয়ে শুয়ে কাঁদে। আর ভাবে একদিন আমি এই মায়ের আদরের খনি ছিলাম। আজ ছোটো ভাই আদর আমার সবটুকু কেড়ে নিয়েছে। মায়ের সঙ্গে একটু ঘেঁষতেও দেয় না। ভাইটা আসলে হিংসুটে। বোঝলাম ও ছোটো। মা তো আর ছোটো না। মা আমাকে একটুও আদর করে না।
জানালা দিয়ে উঁকি মেরে মা দেখে তুষার কাঁদছে । আদরকে ডেকে বলল যাও দাদাকে ডেকে আনো। দাদার সঙ্গে তুমি খারাপ আচরণ কর বলে দাদা মনে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। সে তোমার বড় ভাই। বড় ভাইয়ের সঙ্গে কেউ এমন আচরণ করে?
মায়ের কথা আদরের মনে ধরেছে। তুষার তো আমার দাদা তার সঙ্গে এমন চলাফেরা কথা বলা ঠিক না। আদর নিজের ভুল বুঝতে পেরে তুষারকে দাদা বলে ডাকতে না ডাকতে তুষার আদরকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
তুই আমাকে দাদা বলে ডাকলি আদর?
তুমি তো আমার দাদা। দাদা বলে না ডাকলে কাকে দাদা বলে ডাকব? তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও দাদা।
তুষার আদরের ব্যবহারে খুব খুশি হল। আজ থেকে তার মনে কোনো দুঃখ থাকল না। দুই ভাই এক সঙ্গে খেলে এক সঙ্গে হাঁটে। একটা খাবার দুইজনে ভাগ করে খায়। হেসে খেলে এক সঙ্গে ইশকুলে যায়। এইসব দেখে মায়ের দুই চোখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এই পানি দুখের নয় খুশির। দুই ভাইয়ের মিল দেখে। গ্রামের মানুষ দুই ভাইকে এখন মানিকজোড় বলে। মা বলে বাংলার সব ভাইয়েরা যেন আমার এই দুই ছেলের মতো হয়। বিধাতা এইটুকু শুধু চাই।