আগামী ১৫ এপ্রিল থেকে ৫৮ দিনের জন্য বন্ধ হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরার কার্যক্রম। ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের প্রজনন মৌসুমকে নিরাপদ রাখতে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে। তবে মাছ শিকারের সাথে জড়িতরা দীর্ঘদিন ধরে একইসাথে টানা বন্ধ না করে বিভিন্ন মাছের প্রজনন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের মাছ শিকার বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে আসছে।
তাদের মতে, ইলিশসহ অন্যান্য কয়েক প্রজাতির মাছের সাথে চিংড়ির প্রজনন সময়কালের কোন মিল নেই। কিন্তু ইলিশের সাথে চিংড়ি মাছ শিকারও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের অন্যতম হিমায়িত রপ্তানি পণ্য গলদা চিংড়ির উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে উঠে। মাছ শিকারীদের মতে, গলদা চিংড়ির প্রজনন সময়কাল হচ্ছে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি দুই মাস। ওই দুই মাস চিংড়ি শিকার বন্ধ রাখলে সুফল মিলতো। কিন্তু দেশে ওই দুই মাস অবাধে মাছ শিকার চলে। আর যখন চিংড়ি শিকারের ভর মৌসুম তখন শিকার বন্ধ রাখতে হয়। এতে হ্যাচারিগুলো মা চিংড়ির অভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে। এই সময় ভারত থেকে নিম্নমানের পোনা এনে চাষ করতে গিয়ে বহু চাষি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক হ্যাচারি। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছে। যা দেশের রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
সূত্র জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র চলে আসছে। দেশে মাছ শিকার বন্ধ রাখার সময়কাল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত হয়েছে। অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতের সাথে মিল রেখে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা বেশ ভালো সুফল আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগে যখন আমাদের জেলেরা সাগরে যেতে পারতেন না, তখন ভারতীয় জেলেরা আমাদের জলসীমা থেকে অবাধে মাছ শিকার করে নিয়ে যেতেন। এখন অন্তত তা বন্ধ হবে।
তবে চিংড়ি শিকার বন্ধের সময়কাল নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। বিশেষজ্ঞদেরও এই ব্যাপারে সরকারের সাথে ভিন্নমত রয়েছে। তাদের মতে, চিংড়ি শিকারের জাহাজ আলাদা। যেসব জাহাজ চিংড়ি শিকার করে সেগুলো অন্য মাছ শিকার করতে পারে না। চিংড়ির প্রজনন সময়কাল হচ্ছে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। ওই সময় চিংড়ি মাছ শিকারে নিয়োজিত জাহাজগুলোকে সাগরে যেতে না দিয়ে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের জন্য যখন মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয় তখন চিংড়ির জাহাজগুলো যাতে সাগরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হচ্ছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু তা কার্যকর না হওয়ায় চিংড়ি মাছ শিকারে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বহু জাহাজই চিংড়ি শিকার বন্ধ করে দিয়েছে। কোন কোন জাহাজ ধরণ পাল্টে ফেলেছে। চট্টগ্রাম থেকে ৪২টি চিংড়ির জাহাজ চলাচল করতো। এখন তা কমে ২৪টিতে নেমে এসেছে। এরমধ্যে ২০টি সাগরে মাছ শিকারে গেলেও অপর চারটি অনিয়মিত বলে সূত্র জানিয়েছে।
শিকারের মৌসুমে সাগরে যেতে না পারায় মা চিংড়ির চরম অভাবে পড়ে হ্যাচারিগুলো। নানাভাবে আর্থিক ক্ষতির কবলে পড়ে এসব হ্যাচারি। এতে করে একের পর এক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাওয়ারও ঘটনা ঘটছে। কঙবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত এলাকায় ৬০টির মতো হ্যাচারি ছিল। বর্তমানে তা ৩০টিতে নেমে এসেছে। এরমধ্যে ২০টির মতো হ্যাচারি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। বাকিগুলো উৎপাদনে নেই।
সূত্র বলেছে যে, দেশীয় হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিংড়ি চাষ বহুলাংশে ভারতীয় পোনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভারত থেকে নিম্নমানের ডিম এনে হ্যাচারিতে বাচ্চা ফুটানো হচ্ছে, চোরাপথে ভাইরাসযুক্ত পোনা এনে চাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। ফলে চিংড়ির উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বহু ঘের মালিক চিংড়ির পরিবর্তে কাঁকড়া উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে বলেও সূত্র জানায়।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম নামের একজন হ্যাচারি মালিক বলেছেন, সাগরে মাছ শিকার বন্ধ হয়ে গেলে হ্যাচারিগুলো মা চিংড়ির অভাবে পড়ে। তখন আর পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। রোগাক্রান্ত পোনা ও পার্শবর্তী দেশ থেকে আসা কিছু পোনার ওপর ভরসা করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। যা দেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত আমাদের চিংড়ি রপ্তানি ব্যাহত করছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই–ফেব্রুয়ারি) চিংড়িসহ হিমায়িত ও জ্যান্ত মাছের রপ্তানি হয়েছে ৩১৬.২ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু চিংড়ির রপ্তানি হয়েছে ২১৫.৯ মিলিয়ন ডলার। চিংড়ি রপ্তানির এই ধারা ধরে রাখা কিংবা বাড়াতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দরকার বলেও সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।