বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে গুলিতে এক হোটেল কর্মচারী আহতের ঘটনায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টার মামলায় হবিগঞ্জ–৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। মিরপুর মডেল থানার এ মামলায় গতকাল মঙ্গলবার সুমনকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আব্দুল হামিদ। রাষ্ট্রপক্ষে পিপি ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে ঢাকার মহানগর হাকিম জাকির সোসাইন সাবেক সংসদ সদস্যকে পাঁচ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। খবর বিডিনিউজের।
৫ আগস্টের আগে–পরে যে কয়েকজন এমপি–মন্ত্রীর দেশ ছাড়ার খবর বেরিয়েছিল, তার মধ্যে ব্যারিস্টার সুমনের নামও ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সরকার পতনের প্রায় আড়াই মাস পর সোমবার গভীর রাতে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে সুমনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। তার আগে রাতে এক ফেইসবুকে পোস্টে তিনি লেখেন, আমি পুলিশের সাথে যাচ্ছি। দেখা হবে আদালতে। দোয়া করবেন সবাই।
তবে গতকাল বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে আদালতে তোলার সময় কাঁদতে দেখা যায় সাবেক এই সংসদ সদস্যকে। বিএনপি সমর্থক একদল আইনজীবী তখন ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে শুরু করলে পিপি ওমর ফারুক ফারুকী তাদের শান্ত করেন।
আদালত জামিন নাকচ করে রিমান্ডের আদেশ দিয়ে এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার পর ব্যারিস্টার সুমন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকীকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে চান। কিন্তু ফারুকী কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এ সময় সুমন বলেন, আপনার সাথে আলাদা করে কিছু বলব না স্যার। আপনার মাধ্যমে সকল আইনজীবীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি খুব সরি স্যার।
পরে রিমান্ড শুনানিতে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, সে একজন ব্যারিস্টার। ৫ আগস্টের পর দেখলাম সে লন্ডন থেকে কথা বলেছে। জনগণকে বুঝিয়েছে সে দেশে নাই সে লন্ডন আছে। শুরু থেকেই সে চতুরতা করে আসছে। চতুরতাই তার কাজ। পরে দেখা গেল তার বোনের বাসা থেকে তাকে আটক করেছে। সে নিজেকে দাবি করে সে সেলফি এমপি। সংসদে দাঁড়িয়েও সে বলেছে সে সেলফি এমপি। বিদেশ থেকে মানুষজনের কাছ থেকে টাকা এনে এলাকায় কয়েকটা ব্রিজ বানিয়ে সে এলাকার মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে। তাছাড়া নতুন এমপি হলেই দেখি এমপিরা গাড়ি কেনে। সেও সবচেয়ে দামি গাড়ি কিনে এনেছে, কিন্তু গাড়িটা চালাতে পারে নাই।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, সে এলাকার মানুষের সাথে প্রতারণা করে এমপি হয়েছে। কোটা আন্দোলনের সময় হাই কোর্টে সংবাদ সম্মেলনে করে সে হাসিনার পক্ষ নিয়েছে। তখন সে বলেছে, পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই যে হাসিনাকে সরাতে পারে। সে এখন আদালতে কেন? সে তো ব্যারিস্টার। সে এমন কাজই করেছে যে স্বৈরাচারের পতনের পর সে বোনের বাসায় আত্মগোপন করেছে। আর মিরপুরে হামলার কারিগর সে। এবং তার পালিয়ে থাকারও ঠিকানা মিরপুর। এতেই বোঝা যায় সে যে এখানে জড়িত। এই যুবক বয়সে তার উচিত ছিল ছাত্রদের সাথে থাকা, আন্দোলনের সাথে থাকা। অনেক ব্যারিস্টারই ছাত্রদের সাথে ছিল কিন্তু সে আরেকটি মেয়ে নিয়ে কোটাবিরোধী বক্তব্য দেয়।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে বলেন, যে মামলায় রিমান্ড চাওয়া হয়েছে সে মামলায় আসামির তালিকায় ব্যারিস্টার সুমনের নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। এজাহারে সুনির্দিষ্ট কিছু নাই। তাকে জামিন দেওয়া হোক।
মামলায় যা আছে : এ মামলার বাদী হৃদয় মিয়া মিরপুরের বাঙালিয়ানা ভোজ হোটেলের সহকারী বাবুর্চি। তিনি হবিগঞ্জের মাধবপুর ১০ নম্বর হাতিয়াইন ইউনিয়ন যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই গুলিতে আহন হন হৃদয়। সরকার পতনের পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় তিনি এই হত্যাচেষ্টা মামলা করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ঘটনার দিন মিরপুর–১০ নম্বর গোলচক্করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা লোহার রড, হাসুয়া, পিস্তল, আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শাস্তিপূর্ণ সমাবেশে বেপরোয়া আক্রমণ শুরু করে। আসামিরা অস্ত্র দ্বারা বাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। বাদীর ডান পায়ের হাঁটুর উপরের বাটি গুলি লেগে দুই ভাগ হয়ে যায়। পরে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন বাদীকে জাতীয় অর্থপেডিঙ হাসপাতালে নিয়ে যায়। বাদীর ডান পায়ের হাঁটুর ভেতরে গুলি থাকা অবস্থায় ১৩টি সেলাই করে পা বেঁধে দিয়ে তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে গিয়ে বাদীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় এলাকার লোকজনের সহায়তায় তাকে ৩ আগস্ট আবার পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং তখন তার বুলেটটি বের করা হয়।
পুলিশের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, মামলার ঘটনায় গোপনে ও প্রকাশ্যে যে প্রাথমিক তদন্ত করা হয়েছে, তাতে সুমনের জড়িত থাকার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ব্যারিস্টার সুমন এ মামলার ৩ নম্বর আসামি। তিনি একজন ব্যারিস্টার বিধায় জিজ্ঞাসাবাদে মামলার ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে প্রশ্নের উত্তর কলাকৌশলে এড়িয়ে যায়। তিনি তার সংসদীয় আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগের একজন উদীয়মান নেতা এবং আওয়ামী লীগসহ তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীগণ উক্ত আসামির নির্দেশনা অনুসরণ করে থাকে।