ব্যাংক মার্জ সমস্যার সমাধান নয় বরং আরেকটি সংকট

ফারজানা আজিম | মঙ্গলবার , ২৯ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে সমপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে যে দুর্বল ব্যাংকগুলিকে একে অপরের সঙ্গে মার্জার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটি আমার মতে কোনোভাবেই অর্থনৈতিক সমস্যার কার্যকর সমাধান হতে পারে না। বরং এটি আরো একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটের জন্ম দিবে। দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের মার্জার মানেই দুটি সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করা, যাতে সমস্যার গভীরতা আরো বাড়ে, সমাধান নয় ।

এই প্রক্রিয়ায় কিছু অফিসার ম্যানেজার ও সাধারণ কর্মচারী চাকরি হারানো সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল। একটি দুর্বল ব্যাংকের সাথে আরেকটি দুর্বল ব্যাংক মার্জ করে আদতে কিছুই অর্জিত হবে না। বরং কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে, কর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়বে এবং জন আস্থা আরও হ্রাস পাবে। ব্যাংক মার্জারের নামে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে, কর্মচারীদের ছাটাই, প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্ত। আর অকার্যকর সমাধান নয়, ন্যায্য বিচার চাই।

ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের সময় ও শর্ত সাপেক্ষে সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনঃগঠন করা উচিত।

একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে সেই সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে নিজেদের আর্থিক কাঠামো, পরিচালন ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করাই হবে টেকসই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত।

প্রয়োজনে সেই সময়সীমা শেষে ব্যর্থ ব্যাংকগুলিকে সম্মানজনকভাবে এক্সিট করতে দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। কিন্তু মার্জার একমাত্র সমাধান নয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সাম্প্রতিক দুর্বল ব্যাংগুলিকে কেন্দ্র করে বর্তমানে যে অস্থিরতা ও কর্মী ছাটাই এর ঘটনা ঘটছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও ন্যায় সঙ্গত নয়।

অথচ উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি বলেছিলেন, কাউকে ছাঁটাই করা হবে না এবং অতীতের দায় বর্তমান কর্মচারীদের উপর চাপানো হবে না। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শত শত কর্মকর্তা, ম্যানেজার ও পিয়ন ছাঁটাই করা হয়েছে। তাদের কাউকে তাদের ন্যায্য পাওনাটুকু পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। সম্পূর্ণ খালি হাতে এত বছরের কর্মস্থল থেকে বিদায় করছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ আচরণ এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

একটি ব্যাংকের সাফল্য আসে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং মানবিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। শুধু প্রতিশোধ আঞ্চলিক বিদ্বেষ কিংবা অতীতের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে চাকরিচ্যুতি কোনো সুস্থ আর্থিক সংস্কৃতির উদাহরণ হতে পারে না।

কর্মচারীদের প্রতি অবিচার করে, তাদের সম্মানহানি ঘটিয়ে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একের পর এক ‘দুর্বল ব্যাংক’ বলে অপপ্রচার চালিয়ে একতরফাভাবে মার্জার চাপিয়ে দিচ্ছে, তা ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতা ও সংস্কারের সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করছে।

ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালনা পর্ষদ এইসব সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হলে তারা ন্যায় বিচারের স্বার্থে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই পারে। এতে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আরো বিপন্ন হবে।

মার্জার শুধু দুর্বল ব্যাংকে নয়, সবল ব্যাংকগুলোও অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ক্ষমতাকে আরো বাড়াতে একে অপরের সাথে মার্জার করে থাকে। এতে তাদের অর্থনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তারা নিজেদের ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু দুর্বল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংকের মার্জার কোনো সমাধান নয় বরং বৃহৎ সমস্যার জন্ম।

দুর্বল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংকের মার্জার নয়, প্রত্যেক ব্যাংকে সময় ও সুযোগ দেওয়া হোক, যাতে তারা নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে পারে।

আমার মতে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার কারণ চিহ্নিত করতে স্বচ্ছ তদন্ত করে, শর্তসাপেক্ষে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে সংস্কার মূলক সহায়তা দেওয়া হোক। প্রতিহিংসা মূলক ছাটাই বন্ধ করা হোক এবং অন্যায়ভাবে চাকরি হারানোরদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে সম্মানজনকভাবে বিদায় নিশ্চিত করা হোক। ব্যাংকের মার্জারকে একমাত্র সমাধান ভাবা যাবে না বরং মার্জারের বাইরে অন্য বিকল্প খোলা রাখা হোক। আজ এই লেখার মাধ্যমে আমি বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে ন্যায্যতা, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি ও দেশের সুশীল সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : এক্স ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারী বর্ষণে ডুবল কিছু এলাকা
পরবর্তী নিবন্ধবর্ষা ও তুমি