ঢাকার কেরাণীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় ডাকাত হানা দেয়ার খবরে স্থানীয়দের সহায়তায় বাইরে থেকে চারপাশ ঘিরে ফেলে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী। ভেতরে তখন ব্যাংকের গ্রাহক ও কর্মী মিলে অন্তত ১৬ জন জিম্মি দশায় পড়েন। পরে ডাকাতরা অনন্যোপায় হয়ে ৩ ঘণ্টা পর আত্মসমর্পণ করলে দেখা যায় তিন ডাকাতের মধ্যে দুজন ১৬ বছরের কিশোর; আরেকজনের বয়স ২২, যিনি গাড়ি চালান। তারা চারটি নকল পিস্তল নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে ব্যাংক ডাকাতি ও গ্রাহকদের জিম্মি করার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য। তিন ঘণ্টা পর আত্মসমর্পণের আগে দেশজুড়ে হঠাৎ চাঞ্চল্য তৈরি করা এ ঘটনায় জড়িত তিন তরুণকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এসব তথ্য দেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মেদ মুঈদ। তাদের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা উদ্ধারের তথ্যও দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, আটকদের কাছ থেকে উদ্ধার করা সব পিস্তলই ছিল নকল। এর মধ্যে তিনটি খেলনা পিস্তল আর একটি লাইটার। তবে তাদের কাছে দুটো ছুরিও ছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ তিনজনকে ব্যাংক থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা তিনেক পর রাত ৮টায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসপি মুঈদ বলেন, তাদের অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মনে হয়েছে বিভিন্ন মুভি–টুভি এসব দেখে বা ফেসবুক দেখে ওরা অ্যাডভেঞ্চারের মত করতে গিয়েছিল।
একজন দুস্থ কিডনি রোগীর চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহে তারা সেখানে যাওয়ার দাবি করেছে। এসপি বলেন, পরে অবশ্য তারা বলেছে, তাদের আইফোন পছন্দ। তাদের তিনজনের কাছে থাকা একটি ব্যাগ থেকে ১৫ লাখ ও প্রত্যেকের পকেট থেকে এক লাখ করে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিন দুপুর ২টার দিকে কেরাণীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় একদল সশস্ত্র ডাকাতের হানা দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। তারা ব্যাংকের ১০ জন কর্মী ও একটি শিশুসহ ছয়জন গ্রাহককে ভেতরে জিম্মি করেন। পরে সন্ধ্যায় ডাকাতরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের হেফাজতে নেয় নিরাপত্তা বাহিনী। অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয় জিম্মিদের। এ ঘটনা নিয়ে রাতে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার এসপি বলেন, আমরা খবর পেলাম যে ডাকাতি হয়েছে। জায়গাটা হচ্ছে চুনকুটিয়া। জিম্মি করেছে ১০ জন স্টাফ ও ছয়জন ক্লায়েন্ট, এদের মধ্যে একটা বাচ্চাও ছিল। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বুঝছি তারা মাইনর। একজনের বয়স ২২ বছর, বাকি দুজনই ১৬ বছরের। ওদেরকে অপরাধী বলাটা আমার মনে হচ্ছে তারা কোনোভাবে মিসগাইডেড। এডভেঞ্চার হিসেবে নেওয়ার মতো মনে হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে দর কষাকষির পর তারা আত্মসমর্পন করে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মুঈদ বলেন, ওদের সাথে একটা মোবাইল ছিল। দূর থেকে কথা বলে ওদের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে কথা বলে বিষয়টিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিল আমাদের এডিশনাল এসপি। আমাদেরকে আইজি স্যার লাইভে একটাই নির্দেশনা দিযেছেন, সেটা হল কোনো জীবন যাতে এখানে না যায়। কোনো অস্ত্র ব্যবহার না করে যতটুকু পারা যায় নেগোশিয়েট করে সফল হতে হবে। তাই দীর্ঘ সময় নিয়ে কয়েক দফায় তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কথা আমরা শুনেছি।
মোবাইলে দর কষাকষির সময় তারা পুলিশকে বলে একজন দুস্থ রোগীর জন্য টাকা সংগ্রহে তারা এখানে এসেছে। এসপি বলেন, তারা বলেছিল মৃত্যুশয্যায় একটা কিডনি রোগীকে বাঁচানোর জন্য তাদের টাকা দরকার। আমরা তখন প্রাথমিক পর্যায়ে (নেগোসিয়েশনের সময়) বলেছিলাম যত টাকা দরকার তোমরা নাও, আমরা পৌঁছায় দেব। ওদের বলেছি কারও ক্ষতি করবে না, একজনেরও যেন ক্ষতি না হয়। ওরা কথা দেয় কারও ক্ষতি করবে না। আমরা তখন তাদের অ্যাপ্রিসিয়েট করেছি। তাদের ছোটভাই বলে, সন্তান বলে বারবার বুঝিয়েছি। আমরা বলেছি, তোমাদের এখানে কোনো দোষ দিচ্ছি না। অনেকভাবে আমরা কথা বলে তাদেরকে ফাইনালি কনভিন্স করতে পেরেছি। পরে তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য বলে। আমি বলেছি আগে অস্ত্র দিয়ে দেবে। তারপরে তোমরা টাকা নিয়ে বের হয়ে আসবা। ১৮ লাখ টাকা ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি।
তিনি বলেন, তাদের অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে মনে হয়েছে বিভিন্ন মুভি–টুভি এসব দেখে বা ফেসবুক দেখে ওরা অ্যাডভেঞ্চারের মতো করতে গিয়েছিল। তারা যে পেশেন্টের নাম ও ঠিকানা দিয়েছে এখনো আমরা যাচাই করছি। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না ওদের মোটিভ কী ছিল। ওরা আবার আইফোন কেনার একটা কথা বলেছে, আইফোন ওদের পছন্দ।
তাদের পরিচয় জানতে চাইলে এসপি বলেন, ওরা পড়াশোনা করেছে, মাদ্রাসার ছাত্র। একজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। প্রাইভেট গাড়ি চালাত, তার বাড়ি গোপালগঞ্জে কাশিয়ানি। বাকি দুজন এখানকার লোকাল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যেটা পেয়েছি, তারা একটা প্ল্যান করেছিল। আমরা যখন নেগোশিয়েট করি তখন বলেছি এরকম টাকা তো আমরা ডোনেশন দিতে পারতাম। তখন তারা বলেছিল ব্যাংকের কর্মকর্তারা সব দুর্নীতিবাজ। ওদের একটা পরিকল্পনা ছিল। ওরা তিনজনই একই রকমের পোশাক, মাস্ক সংগ্রহ করেছে।
ব্যাংকে ঢোকার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মুঈদ বলেন, ব্যাংকের যে সিকিউরিটি গার্ড তিনি তার সিটে ছিলেন না। কিন্তু ওই সময় আরেকজন পিয়নকে গার্ডের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। ওরা যেহেতু আর্মস নিয়ে ঢুকেছে, টিনেজ, সবাই ভয় পেয়েছে। সবাইকে হেডডাউন করতে বলেছিল।পরে ওরা ভেতরে আটকা পড়ে যায়। ওরা ব্যাংকে বলেছিল ওদের আরও লোক আছে আশপাশে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে ওরা বলেছে এগুলো আপনাদের ভয় দেখানোর জন্য বলেছিলাম।
কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততা আছে কী না, এদের কোনো বড়ভাই গাইড করেছে কী না এসব খতিয়ে দেখবে পুলিশ। তবে তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা ভাবার কথা বলেন পুলিশ সুপার।