বর্তমান করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে স্থবিরতা। কঠোর লকডাউনে তো বটেই, করোনাকালীন অন্য সময়েও খুব একটা ভালো নেই ব্যবসায়ীরা। তাঁরা প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন। বিধিনিষেধ দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সমপ্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে করোনার শুরু থেকে মে পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘করোনার প্রভাবে দেড় বছরে ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহ বাড়লেও ঋণের প্রবাহ বাড়েনি। এতে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে অলস টাকা। অবশ্য করোনার মধ্যে আর্থিক খাতে অনলাইন লেনদেন ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বাড়লেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় খাত। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেই কর্মসংস্থান কমেছে আর এর প্রভাবে হ্রাস পেয়েছে মানুষের আয়। আয় কমে যাওয়ায় আর্থ-সামাজিকভাবে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী দুর্বল অবস্থানে নিপতিত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় করোনা মোকাবিলায় সব মানুষকে টিকার আওতায় আনার পাশাপাশি দেশে বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করে বিনিয়োগে মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’ অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার যে বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাকেও উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরি পলিসি বিভাগের মাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এর মানে, এ সময়ে ঋণ কম নিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। আর এ কারণে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে দশমিক ৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল থাকলে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে। কারণ, বেসরকারি উদ্যোক্তারা তখন প্রয়োজনে অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করে থাকেন, যা বর্তমানে দৃশ্যমান নয়। বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে এ মন্দাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মূলত করোনা মহামারির কারণে। মহামারি সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশেও। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাজনিত কারণে চলতি অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রাও কাটছাঁট করা হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় নতুন শিল্পকারখানা স্থাপিত হচ্ছে না। এ কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যাচ্ছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। বিনিয়োগ না বাড়লে যে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য বড় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি-ক্ষুদ্রসহ সব শ্রেণির উদ্যোক্তা যেন প্রণোদনার সুফল পান, তা নিশ্চিত করা জরুরি।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। আগে আমদানি করা পণ্য ও কাঁচামালের মজুদ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ দুই ক্ষেত্রেই তারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মহামারির কারণে জীবিকা হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তাদের মধ্যে যারা হতদরিদ্র, তাদের না খেয়ে থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জীবিকা হারিয়ে নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ মানুষ। প্রতিদিন এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনার কারণে লকডাউন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাত থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশ সরকারি কোনো সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত নয়। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক প্রাপক অনিয়মের মাধ্যমে প্রকৃত প্রাপককে বঞ্চিত করে এ সুবিধা ভোগ করছে। ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
তবু আশার কথা, সরকার করোনার ধাক্কা সামলানোর জন্য ইতোমধ্যে নানা রকম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর আগে আমাদের অর্থনীতি নানামুখী প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ অতিক্রম করে এগিয়েছে। দেশের পরিশ্রমী মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। এবারও আমরা প্রত্যাশা করি, ব্যবসায়ীরা তাঁদের মেধা, কৌশল ও পুঁজিকে যথাসাধ্য ব্যবহার করবেন। ধীরে ধীরে কেটে উঠুক স্থবিরতা।