বৌদ্ধ নারীর আর্তনাদ : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

উর্মিলা বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

এনলাইটেনমেন্ট এর ছোঁয়া কি বাংলাদেশের বৌদ্ধদের লাগেনি অথচ আমরাই ছিলাম এর বাতিঘর। ইউরোপীয় এই এনলাইটেনমেন্টকে বলা হতো ‘দ্যা এইজ অফ রিজন’। ১৮শতকের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক আন্দোলন সেদিন কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার উপর কার্যকারণের ভৌতসম্পর্কের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো। আন্দোলনের ঢেউ এসেছিলো আমাদের উপমহাদেশেও। সেই ঢেউয়ে সতিদাহ প্রথা বিলুপ্ত হলো, বিধবাবিবাহ চালু হলো, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হলো ভারতবর্ষে। তারপর গঙ্গা পদ্মার জল প্রবাহিত হয়েছে অনেক অথচ সেই জলে আমরা খুব কমই শুদ্ধ হয়েছি। সমাধিকারের জয়যাত্রা সর্বত্র অথচ বাতির নিচে অন্ধকার রয়েই গেল। আজও পুরুষতান্ত্রিক জাঁতাকলের নিচে পিষ্ট হচ্ছে আমাদের নারী সমাজ। আজও বহুবিবাহের অভিশাপ বয়ে চলে হাজারো বৌদ্ধ নারী।

বিবাহ হল একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি যা একজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে স্বামীস্ত্রী হিসেবে বসবাস করার সুযোগ দেয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এই প্রথা ধর্ম, সমাজ ও দর্শন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে আসছে। কালের পরিক্রমায় যেমন এসেছে বৈচিত্র্যময়তা, তেমনি যুক্ত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক ভ্রষ্টতা। সামাজিক ভারসাম্য নষ্টকারী বহুবিবাহ। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। ফলে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র বিয়েটাকে সামাজিক স্বীকৃতির সাথে সাথে আইনগত চুক্তি হিসেবে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে বহুবিবাহ কবে থেকে প্রচলন ঘটেছে সঠিকভাবে জানা যায় না। তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বহুবিবাহের অবস্থান নিয়ে আরেকটু স্বচ্ছ ধারণার প্রয়াস নেওয়া যাবে।

ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহ ধারণা এবং অনুমোদন নিয়ে বহুধা বিভক্তি রয়েছে। সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিতরা এটাকে সুষ্ঠু সংস্কৃতির অংশ মনে করে না। এক্ষেত্রে তারা আলী বিন আবুতালিবের ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যিনি নবী মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাকে বিয়ে করেছিলেন এবং নবী কর্তৃক দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি প্রাপ্ত হননি। যা হোক, কোরআনে শর্ত শর্তসাপেক্ষে বহুবিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, শর্তসমূহের মধ্যে একটা হলো সব স্ত্রীর সাথে সমান আচরণ করা অন্যথায় একক বিয়েকেই উত্তম আচরণ বলা হয়েছে। সর্বপরি ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতির বাধ্যবাধকতা ও বহুবিধ শর্তাদি যুক্ত করা হয়েছে এবং রয়েছে দণ্ডবিধি।

হিন্দু ধর্মের ঐতিহাসিক মহাকাব্যগুলোতে যদিও নারী পুরুষ উভয়েরই বহুবিবাহের অস্তিত্ব পাওয়া যায় তবে ভারতের সংবিধানে সকল ধরনের বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জৈন, শিখ সমপ্রদায় অন্তর্ভুক্ত।

ত্রিপিটকে বিবাহ সংক্রান্ত কোনো বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ নেই। ফলে অনেকেই এই উন্মুক্ততাকে বহুবিবাহের অনুসঙ্গ হিসেবে নিয়ে নেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় বুদ্ধের অনেক শিষ্য ছিলেন বিশেষত রাজন্যবর্গ যাদের একাধিক স্ত্রী ছিল। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় কারণ সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বুদ্ধের সাথে দেখা হওয়ার আগেই তাদের একাধিক স্ত্রী ছিল। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মে বিয়েটাকে সম্পূর্ণভাবে সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। ধর্ম এখানে একেবারেই নাক গলায়নি বরং সম্পূর্ণভাবে সামাজিক এবং নৈতিক ধ্রুব মানদণ্ডের কাছে সমর্পণ করেছে। অধিকন্তু যেটা দেখা যায় তা হলো, ত্রিপিটকে বুদ্ধ তার অনুসারীদের এক স্ত্রীতে সন্তুষ্ট থাকতে বলেছেন, যা সর্বজনীন মানবাধিকার এবং সমাধিকার সমর্থন করে।

তূলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বৌদ্ধ নারীর অধিকার বিশেষ করে বিবাহিত নারীর অধিকার নিয়ে বিশ্লেষণ করলে, এই ধর্মের মানবিক ও সেক্যুলার বৈশিষ্ট্য ম্লান হয়ে পড়ে। নারীরা এখানে অরক্ষিত। নারীর আর্তনাদ আর বোবাকান্না বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টার সাথে ঐকতান হয়ে বেজে উঠে। এ দায় ধর্মের নয়, এ দায় পুরুষতান্ত্রিকতার এবং পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত নারীসমাজের। নারী এখানে অবহেলিত এবং আলো থেকে আলোকবর্ষ দূরে। বৌদ্ধ নারীকে রাষ্ট্র দেয়নি কোনও রক্ষাকবচ। এই একাবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক যুগেও এখানে বৌদ্ধ বা সনাতনী নারী তূলনামূলকভাবে অধিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এ নিরাপত্তাহীনতা থেকে কোনও নারী যদি ধর্মান্তরণের পথে চলে, কে ফেরাবে, ধর্মাবতার?

গৌতম বুদ্ধের গৃহকালীন সময়ে একজন স্ত্রী ছিলেন তবে তিনি অনুসারীদের বাধ্যবাধকতা গণ্ডির মধ্যে না রেখেও যে শিকল পড়িয়েছেন তা হলো সম্পর্কের মধ্যে সমপ্রতি, সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। তবে কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন বৌদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে বুদ্ধের শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে বুদ্ধ যে নৈতিক ও দায়িত্বশীল আচরণকে উৎসাহিত করেছিলেন তা মূলত একগামী সম্পর্কের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বৌদ্ধ ধর্মে মানবাধিকারের কথা বলে, বলে সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার কথা। মানবাধিকার হলো মানুষের প্রকৃতিগত অধিকার যা সমাজে বসবাসরত মানুষ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া। মানবাধিকার নিজের অধিকার আদায়ের কথা বলে, অন্যের অধিকার আদায়ে নিজেকে সংযুক্তির কথা বলে। যেসব সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন আছে সেখানে নারী অধিকার বঞ্চিত হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা এখানে প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়।

বহুবিবাহের স্বীকার নারীসত্তার জন্য অবমাননাকর। ফলে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। নিজের জন্য যে ধরনের চিন্তা করাটাকেও নারী অনাচার মনে করে, তা একজন পুরুষ কতো সহজেই আচার বানিয়ে ফেলে! ফলে নারীর মধ্যে একধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়। সামাজিকভাবেও আত্মমর্যাদাহীনতা বোধ করে। অনেক নারী হয়তোবা এ ধকল সামলে উঠতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মায়ের এই মানুষিক অসাম্যতা সংক্রমিত করে তার সন্তানদের এবং তার বৃদ্ধ বাবামাকে। সন্তান ও বাবার মধ্যে একধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় বিশ্বাসহীনতা। সন্তান নিজেকে বঞ্চিত মনে করতে থাকে। একইভাবে বৃদ্ধ বাবামার জন্য এটা খুবই অসহনীয়। এ মানসিক চাপ নেয়ার মতো সক্ষমতা সবার থাকে না। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটাকে হত্যা বলা যাবে? এর দায়ই বা কে নেবে? সেই মহারথী যার কাছে বিশ্বাস, আস্থা, পরিবার সন্তানের ভবিষ্যৎ সবই ছিলো তুচ্ছ নাকি রাষ্ট্র?

বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মানুষের কল্যাণ নিয়ে ভাবেন, ভাববেন নারীর সুরক্ষা নিয়েও। ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে বিবাহ নথিভুক্ত করার, যেখানে দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতির বাধ্যবাধকতা থাকবে, থাকবে পূর্বতন বৈবাহিক ইতিহাস। অন্যথায় এই অনাচার সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র এক সস্তা বিনোদনের পাথেয় হিসাবে। হুমকির মুখে সভ্যতা, পরিবার ব্যবস্থা। আধুনিক যুগেও আমরা প্রত্যক্ষ করবো যত্রতত্র মধ্যযুগীয় বহুবিবাহ ফ্যাশন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। লাখো শহীদের রক্ত আর নারীর ইজ্জতের অর্জন এই স্বাধীনতা। আমাদের রয়েছে এক অনন্য সংবিধান যা নিশ্চয়তা দেয় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী কিন্তু একজন বৌদ্ধ নারী পুরুষতান্ত্রিক বহুবিবাহ নামক অনাচার স্বীকার হয়েও কোনও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পায় না, এটাকি বৈষম্য নাকি স্রেফ অবহেলা?

সবশেষে ধম্মপদ থেকে বুদ্ধের দুটি লাইন যোগ করবো। ‘স্বাস্থ্য সর্বোচ্চ লাভ, তৃপ্তি বড় ধন। আত্মীয়দের মধ্যে বিশ্বস্তরা সর্বোচ্চ এবং নিব্বানা সবচেয়ে বড় সুখ।

লেখক: প্রকৌশলী, শিক্ষকইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, এসআইপিআই

পূর্ববর্তী নিবন্ধহে আর্য পুরুষ
পরবর্তী নিবন্ধশিশুর মন মানসিকতা