বৈষম্যহীন সমাজ ভাবাদর্শ সাধারণ জনগণের স্বপ্ন

রিজোয়ান মাহমুদ | বৃহস্পতিবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সামাজিক দৈন্য ও অবক্ষয় চূড়ান্ত ভয়ংকর একটা জায়গায় উপস্থিত। একটা সংকীর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা আচ্ছন্ন। সংকট এভাবে বাড়তে থাকলে এ জাতির স্থান হবে জাদুঘরে, নিশ্চিত। প্রতিদিন অনেক সমস্যা সংকটের কথা প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমনকি প্রতিদিনের আড্ডায়, গালগল্পে, যা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করছে সকলকে। কোথায় আছি আমরা! শুনতে হচ্ছে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে মারধর করে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষকদের জবরদস্তি অবসরে পাঠানোর জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখতে হবে ইহজন্মে কল্পনা করা যায় না। শিক্ষা ও শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড। জাতিকে সোজা করে দাঁড়ানোর সবক দেয় শিক্ষকরা। শিক্ষকছাত্র ও জাতির অভিভাবক। যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশের মেধাবী আগামী প্রজন্মকে খুঁজি সে শিক্ষক যদি গলা অব্দি অনাচারে অন্যায়ে ডুবন্ত থাকে, দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠে সে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী! এটাও ভীষণ ভাবায় আজকাল। ভালো মন্দ দুটো দিক আছে। হাদিসে আছে মা বাবার পরে শিক্ষকের স্থান। অর্থবিত্তের জোর না থাকলেও সৎ শিক্ষকেরা সমাজের সম্মানিতজন সবসময়। আমাদের সমকালের শিক্ষকেরা সে সম্মান ও ন্যায়বোধ নিয়ে চলা ফেরা করতেন। সে কারণে শিক্ষকের জীবনযাপনকে আদর্শ ভেবেছি সর্বদা। অথচ চল্লিশ বছরে পাল্টে যাওয়া সমাজ বাস্তবতায় ভিন্ন এক ধরনের শিক্ষক ও ছাত্রের দেখা মিলছে অহরহ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী গলায় গলায় ভাব, বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব যদি পড়ালেখায় হয়ে ওঠে ক্ষতি দেখি না। পড়ালেখার উছিলায় বন্ধুত্ব যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তা হয়ে ওঠে দৃষ্টিকটু।

বলা হচ্ছে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। বেত মারা সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অথচ ধীরে ধীরে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গা শূন্য হয়েছে। শিক্ষকরাও দলাদলিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে। মান্যতা নেই, বই পুস্তকের সাথে সম্পর্ক রহিত শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক যখন পোষ্য ছাত্রদের নিয়ে প্রশাসনের যোগসাজশে শিক্ষা প্রকল্পের বরাদ্দ টাকা ভাগাভাগি করে, সার্টিফিকেট ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে তখন পরস্পরের সম্মানের জায়গা সংকোচিত হতে থাকবে, নিশ্চিত। এমনও হয়েছে মেধাবী ছাত্রদের বাইরে রেখে পর্দার আড়ালে পোষ্য খারাপ ছাত্রদের বেশি নম্বর পাইয়ে দিয়ে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এবং এতে পর্যাপ্ত উৎকোচ পেয়েছে সে সব শিক্ষকেরা। প্রত্যেক স্কুল কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে চলে পাহাড় সমান দুর্নীতি। শিক্ষাবর্ষের যেকোনো দুটিতে তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্তরা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। যাদের নিজেদের শিক্ষারুচি ঠিক নাই, তারা ক্লাসে পাঠ দেবে ছাত্রদের। এমন আহাম্মকের দেশ বাংলাদেশ! এহেন অনিয়ম সব সরকার আমলেই বিদ্যমান ছিল। কোনো সরকারের মন্ত্রী আমলারা শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিসিপ্লিনে আনতে পারেনি। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিজেরা নিমজ্জিত থাকলে ভালো কিছু হবে কী করে! রাজনীতি এখন এদেশের প্রধান ব্যবসা। শিক্ষানীতিও উল্লেখযোগ্য ব্যবসার অংশ। অন্যদিকে ডক্টরেটে ভরে আছে দেশ। এটা খারাপ কিছু না। বাইরে থেকে কেউ এসে দেখলে ভাববে দেশে উচ্চশিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ প্রগতির ধাপে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কতটা পিছিয়েছে সে ধারণা নিয়ে সে ফেরত যাচ্ছে না। সব ডক্টরেটধারী মানের দিকে খারাপ তা বলা যাবে না। অনেকেই আছে বিষয়ভিত্তিক প্রকৃত গবেষণা পত্র বা থিসিস পেপার যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সাবমিট করে ডক্টরেট ডিগ্রি পাচ্ছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য তাঁদের সংখ্যা নগণ্য। বেশিরভাগ ডক্টরেটধারীরা পদোন্নতিপ্রাপ্তির জন্য এই অমূল্য ডিগ্রি অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এদিকওদিক থেকে কপি করে থিসিস সাবমিট করে ডক্টরেট প্রাপ্তি ঘটছে খুব সহজই। শোনা যাচ্ছে বড় লোকের কন্যাকে বিয়ে করার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রী বেশ কাজ দেয়। রাষ্ট্রীয় সুযোগসহ বেশ সামাজিক প্রাপ্তিও ঘটে। শিক্ষাব্যবস্থাপনা এখন বাজারের পণ্যের মতো। খোলা মার্কেটে বেচা বিক্রি হয়। কিন্তু প্রশ্ন থাকে গুণগত মান কী? অনেকেই ভাবছেন যেনতেনভাবে একটা পিএইচডি থাকলেই হলো, সব দিকেই ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ এর ব্যবহারিক পরিধি সর্বোচ্চ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টজনদের এটি গা সওয়া হয়ে গেছে। বছর শেষে বোর্ডে ৯০ থেকে ৯৫ % পারসেন্ট পাশহার থাকলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ এগিয়েছে ধারণা দেওয়া হয়। সরকার প্রধানকে পাশ ফেলের রেকর্ড তুলে দেওয়ার অর্থ শিক্ষামন্ত্রী দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল ইতিবাচক পরিবর্তন করে দিয়েছে। সরকারপ্রধানও পাশের হার দেখে খুশিতে গদগদকণ্ঠ।

এটি একদিনে তৈরী হয় নি বিগত ১৭ বছর ও তারও পূর্বের সরকার আমলের পতিত শিক্ষাব্যবস্থার হাল। যেসব ছাত্ররা আজ শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছে তারা কেউ প্রকৃত ছাত্র নয়, সেসব নীতিভ্রষ্ট শিক্ষকদের নষ্ট হয়ে যাওয়া ছাত্ররা। যাদের দিয়ে শিক্ষকরা শিক্ষাক্রমের বাইরে ব্যবসা করেছে।

আমরা প্রায়শই বলি মেধাবীরা থাকে না দেশে, যারা দেশের বাইরে পড়তে যায় তারা শিক্ষাবর্ষ শেষ করে ফিরে আসে না। প্রশ্ন হলো, আসবে কেন? সে সমতা বিশ্বাসের পরিবেশ স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অনুপস্থিত ছিল এদেশে। যোগ্যদের মর্যাদা কখনোই দেওয়া হয় নি। আমলা, শিক্ষক, গবেষক, প্রশাসক, সর্বোপরি স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাদের পদপদবী দেওয়া হয়েছে সবটাই ছিল একচোখা একমুখো সিদ্ধান্তে। ফলে সরকারি সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সব অর্থকরী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীদের কাছে ছেড়ে দিয়ে অর্থ লোপাট করার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

স্থানীয় পর্যায়ে দেশ ও সমাজের নেতা বানানো হয়েছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির দারোয়ানকে। জাতীয় পর্যায়ে নেতার টিকিট দেয়া হয়েছে সেসব চোর বাটপার ব্যাংক লুটেরাদের। যে সরকার এসেছে হরিলুট করেছে দেশের সম্পদ। ফরেন রিজার্ভ শূন্য, ব্যাংকে পর্যাপ্ত লিকুইড অর্থ নেই। এপেক্স ব্যাংকের রিজার্ভ ডলার হ্যাকড হয়। ব্যাংকে ঋণের টাকা ফেরত আসে না।

ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এগিয়ে না এলে বোঝাই যেতনা আজকের সরকারি অবস্থা কতটা সংগতিহীন। কতটা নড়বড়ে নাজুক অর্থনীতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাদের বন্ধ চোখ খুলে দিয়েছে যে, অন্যায় করলে পার পাওয়া যাবে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের লাগাতার আন্দোলনে পূর্ববর্তী সরকারের পতন উত্তর সবার গ্রহণযোগ্য নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর তত্ত্বাবধানে একটা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দেশের সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। ভেঙে পড়া শিক্ষাখাত ও অর্থখাতসহ সবকটি গুরুত্বপূর্ণখাতে আমূল ইতিবাচক সংস্কার চায় এদেশের সাধারণ জনগণ। সংস্কারে সময় যতটা লাগে লাগুক একটা বৈষম্যহীন সমাজ ভাবাদর্শ সাধারণ জনগণের স্বপ্ন পূরণের চাবি হোক।

তার আগে দরকার সব জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্রের দরজা খুলে দেয়া।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী বিরাজমান থাকুক কোটি মানুষের হৃদয়ে
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম