বৈষম্যহীন, টেকসই অর্থনীতিতে অগ্রাধিকার

৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট রাজস্ব আয় ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ৩ জুন, ২০২৫ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষায় ভাতা ও উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২০২৫২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা সম্মুন্নত রাখার অঙ্গীকার করে তিনি বলেছেন, দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

গতকাল সোমবার বিকালে অর্থ উপদেষ্টা টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই বাজেট পেশ করেন। তার আগে উপদেষ্টা পরিষদ ওই প্রস্তাব অনুমোদন করে। প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর সংস্থান হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতি বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৬ হাজার কোটি টাকা।

২০২৫২৬ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ১ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট বক্তৃতার শুরুতে অর্থ উপদেষ্টা একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করেন। একইসঙ্গে তিনি স্মরণ করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় শহীদদের। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তিনি বলেন, ২০২৪এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের ওপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি। তিনি বলেন, আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শীঘ্রই পূরণ করতে সক্ষম হব ইনশাল্লাহ।

এবার প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশএ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।

আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তব্যে বলেন, এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সকল স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই। ইনশাআল্লাহ, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আলোকবর্তিকা।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও তা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রশাসন আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবও আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের ওপর পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। এ সকল ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

নড়বড়ে অর্থনীতির গাড়ি নিয়ে তুমুল গতি তোলার চেষ্টা না করে চাকা যেন লাইনচ্যুত না হয়, সেই চেষ্টাই করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। তার পুরনো সমীকরণের বাজেটের শিরোনাম ঠিক করেছেন ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের তিন শূন্য ধারণা থেকে তুলে ধরে সালেহউদ্দিন বাজেট বক্তৃতায় বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমরা যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করেছি তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ; যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের এবং মুক্তি মিলবে বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে। যে স্বপ্নকে ধারণ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভিত রচিত হয়েছিল, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সুন্দর, বাসযোগ্য আবাসস্থল রেখে যেতে চাই, জনগণের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসতে চাই এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ঢেউ। আমরা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবারের বাজেট সাজাবার চেষ্টা করেছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত, ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতি কেজি রেণুর মূল্য দেড় লাখ টাকা