চট্টগ্রাম বন্দরের এলসিএল কন্টেনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বন্দরের জায়গা ও শেড ভাড়া নিয়ে বেসরকারি একটি কোম্পানি প্রাথমিকভাবে আমদানিকৃত কন্টেনার থেকে পণ্য বের করে ডেলিভারি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করছে। ইতোমধ্যে শেড সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। কাস্টমসের অনুমোদনসহ প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর মাসখানেকের মধ্যে এই কার্যক্রম শুরু হবে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহুমুখী সুবিধা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে কার্গো ও কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে খরচ বৃদ্ধি পেলে তা ব্যবসা–বাণিজ্যসহ শিল্পখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
জানা যায়, নানা দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের একটি বড় অংশ আনা হয় কন্টেনারে বোঝাই করে। বিশ্বে দুই ধরনের কন্টেনার সিস্টেম চালু রয়েছে। পুরো কন্টেনারের পণ্য একজন আমদানিকারকের হলে সেগুলোকে এফসিএল (ফুল কন্টেনার লোড) এবং বিভিন্ন আমদানিকারকের পণ্য একটি কন্টেনারে বোঝাই করা হলে সেগুলোকে বলা হয় এলসিএল (লেস দ্যান কন্টেনার লোড) কন্টেনার।
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে বছরে প্রায় ৩২ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এর মধ্যে দুই লাখের বেশি এলসিএল কন্টেনার থাকে। নানা দেশ থেকে আসা এলসিএল কন্টেনারগুলো বন্দরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শেডে আনস্টাফিং করা হয়। কন্টেনার থেকে পণ্য বের করে যার পণ্য তাকে দেয়া হয়। বন্দরের অভ্যন্তরে ১১টি শেডে নিয়মিত এই কার্যক্রম চলে।
এলসিএল কন্টেনারের পণ্য খালাস করতে বন্দরের ভেতরে শত শত ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান প্রবেশ করে। সেখানে চালক ও সহকারী মিলে প্রবেশ করে কয়েক হাজার মানুষ। সবকিছু মিলে বন্দরে হ্যান্ডলিংকৃত কন্টেনারের দশ শতাংশের কম এলসিএল কন্টেনার নিয়ে বন্দরের ব্যস্ততা থাকে। আনস্টাফিং থেকে শুরু করে ট্রাকে পণ্য বোঝাই দেয়াসহ নানা কাজে বড়সড় জায়গা এবং প্রচুর লোকবল যুক্ত থাকে।
বন্দর সূত্র জানায়, এলসিএল কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে শেডের ভিতরে বড় জায়গা লাগে, সময়ক্ষেপণ হয়। এতে বন্দরের অভ্যন্তরে কন্টেনার জটের পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশ্বের উন্নত বন্দরগুলোতে এলসিএল কন্টেনার বন্দরের অভ্যন্তরে খোলা হয় না। এসব কন্টেনার বন্দরের বাইরে নিয়ে খোলা হয় এবং ওখান থেকে আমদানিকারকদের পণ্য ডেলিভারি দেয়া হয়। এতে বন্দরের কাজের গতি বাড়ে।
চট্টগ্রাম বন্দরে এলসিএল কন্টেনার বন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করা হচ্ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এলসিএল কন্টেনার বন্দরের বাইরে নিয়ে গিয়ে আনস্টাফিং করে পণ্য সরবরাহ দেয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নানা কারণে তা ব্যাহত হয়।
অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এলসিএল কন্টেনার বন্দরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। একটি বেসরকারি কোম্পানির সাথে পাঁচ বছরের জন্য সম্পাদিত এক চুক্তির আলোকে এসব কন্টেনার বাইরে পাঠানো হবে। ওখান থেকে ওই কোম্পানি পণ্যগুলো ডেলিভারি প্রদান করবে। বে কার্গো নামের উক্ত কোম্পানি বন্দরের শেড এবং জায়গা ভাড়া নিয়ে এলসিএল কন্টেনার থেকে পণ্য আনস্টাফিং করে সরবরাহ করবে।
চট্টগ্রাম বন্দর ভবন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বন্দর স্টেডিয়ামের পাশে প্রায় ৫ একর জায়গায় ‘এঙ’ ও ‘ওয়াই’ শেড নামে বন্দর কর্তৃপক্ষের দুটি শেড রয়েছে। ১৮ হাজার ৯০৬ বর্গমিটার আয়তনের শেড দুটি দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিকট ভাড়া দেয়া ছিল। এখানে আমদানিকৃত খাদ্যশস্যসহ নানা মালামাল গুদামজাত করা হতো। ইতোপূর্বে ইজারা নেয়া প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি শেষ হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বে কার্গোর সাথে নতুন করে পাঁচ বছরের জন্য শেড ইজারার চুক্তি করা হয়। এখানে বে কার্গো আমদানিকৃত পণ্য বোঝাই এলসিএল কন্টেনার নিয়ে গিয়ে আনস্টাফিং (কন্টেনার থেকে পণ্য বের করা) করে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে পণ্য সরবরাহ দেবে। এক্ষেত্রে তারা সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের কাছ থেকে মাশুল আদায় করবে। এর আগে উক্ত দুটি শেডকে কাস্টমস বন্ডেড এরিয়া ঘোষণা করতে হবে। যেখান থেকে কাস্টমসের অনুমোদনের পরই কেবলমাত্র পণ্য ডেলিভারি দেয়া হবে। ইতোমধ্যে শেড দুটিকে কাস্টমস বন্ডেড এরিয়া ঘোষণাসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কাস্টমসের নিকট আবেদন করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার পর চট্টগ্রাম কাস্টমস প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে সূত্র জানিয়েছে। কাস্টমসের অনুমোদনের পরই বন্দর থেকে এলসিএল কন্টেনার উক্ত দুটি শেডে নিয়ে পণ্য ডেলিভারি দেয়া শুরু হবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে এলসিএল কন্টেনার তুলে দেয়ার বিষয়ে আমদানিকারকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, এলসিএল কন্টেনার বন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু বেসরকারি খাতের মাধ্যমে নয়। আমরা চেয়েছিলাম বন্দরের তত্ত্বাবধানে বন্দরই এই কার্যক্রম পরিচালনা করুক। কিন্তু এখন বেসরকারি খাতে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মাশুল কোন পর্যায়ে আদায় করা হবে তা আগেভাগে ঠিক করতে হবে, নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ যে হারে মাশুল আদায় করত বেসরকারি কোম্পানি যদি তার থেকে বেশি মাশুল নেয় তাহলে আমাদের পক্ষে ব্যবসা বা শিল্প পরিচালনা কঠিন হবে।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ যে হারে মাশুল নিত আমরা সেই হারেই মাশুল পরিশোধ করতে চাই। এর থেকে বেশি হলে আমরা পরিশোধ করতে পারব না।
বে কার্গোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে পাঁচ বছরের চুক্তি করেছি। এলসিএল কন্টেনার আমরাই হ্যান্ডলিং করব। শেড দুটি ইজারা নিয়েছি। এখন শেড সংস্কারের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। একটি শেড পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করতে পারব। চট্টগ্রাম বন্দরের সব এলসিএল কন্টেনার আমরা হ্যান্ডলিং করতে পারব না। তবে প্রাথমিকভাবে দৈনিক একশ টিইইউএস কন্টেনার আনস্টাফিং করে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভবিষ্যতে এর পরিধি আরো বাড়বে।
বিষয়টিকে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, আমাদের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এলসিএল কন্টেনার বন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে বন্দরের অভ্যন্তরে জট ও সময়ক্ষেপণ বন্ধ হয়ে গতি আসবে।