বেলায়তের পরিক্রমা ও তার সামাজিক প্রভাব

ডা. সৈয়দ মিশকাতুন্‌ নূর মাইজভাণ্ডারী | মঙ্গলবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ পাক পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি হিসেবে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে নির্দেশ করে সূরা বাকারায় বলেন, ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদ্বে খলিফাতান’। এ মানবতাকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিতে গিয়ে যুগে যুগে আল্লাহর বাণী সমৃদ্ধ কিতাবাদি ও আল্লাহর নূর (হেদায়ত) সমৃদ্ধ হাদী এলাল্লাহগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সূরা রাদে এরশাদ হয়েছে, ‘লি কুল্লি আযালিন কিতাব’। ‘লি কুল্লি কওমিন হাদী।’ যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক জাতির জন্য অবতীর্ণ কিতাব ও হাদীগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল (হেকমত) অবলম্বন করে মানবতার শান্তি ও মুক্তির মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে গেছেন। এজন্যই আমাদের আল্লাহর সাথে সকল নবী রসূলগণ, আসমানী কিতাবসমূহ ও আল্লাহর নির্দেশনা পালনকারী ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান আনতে গিয়ে বলতে হয়, ‘আমানতুবিল্লাহি ওয়া মালাইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রাসূলিহি।’ এর ধারাবাহিকতায় আমরা খাতেমুন নবী (শেষ নবী) হিসেবে পেয়েছি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কে। যার আগমনের শুভ সংবাদ রাব্বুল আলামিন দিয়েছেন ঈসা (আঃ)-এর মাধ্যমে, ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ঈসা (আঃ) আমার পরে তোমাদের জন্য এক মহান রাসূলের (মুহাম্মদ দঃ) শুভ সংবাদ দিচ্ছি যার নাম হবে আহমদ। কুল কায়েনাতকে রাব্বুল আলামিনের দয়ায় সিক্ত করে শান্তির বার্তা প্রেরণের রূপকার মহানবীকে বলেছেন, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি (সূরা আম্বিয়া ১০৭)। আল্লাহর বাণী, ‘তখাল্লাকু বে আখলাকিল্লাহ’, ‘সিবগাতাল্লাহা ওয়া মান আহসানা সিবগাতা’ অর্থাৎ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও; নিজকে আল্লাহর রঙে রাঙাও কারণ তার থেকে উত্তম কোন রঙ নেই। এ রঙে পূর্ণাঙ্গভাবে রঙিন হওয়া মহানবী (দঃ) মানবতার কর্মের সাক্ষী, শুভ সংবাদদাতা ও সতর্ককারী নূর হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা, ‘ইন্না আরসালনাকা শাহেদা ওয়া মুবাশ্বিরা ওয়া নাজিরাঁ ওয়া দাইয়ান ইলাল্লাহি বি ইজনিহি ওয়া সিরাজুম মুনীরা” (সূরা আহযাব)

মহানবী (দঃ) কে আল্লাহ হেকমত, নবুয়ত ও রেসালতের মর্যাদা দান করেছেন। সূরা মায়েদা ৪৮নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আমি প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন শরীয়ত ও বিশেষ পন্থা (তরিকত) নির্ণয় করেছি। শৈশবে হাজরে আসওয়াদ পাথর প্রতিস্থাপনে (ইলমুল বেলায়তের মাধ্যমে) প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ‘ইন্নাল ফিতনাতু আসাদ্দু মিনাল কাতল’ এ বাণীকে মাথায় রেখে আসন্ন ফিতনাকে প্রতিরোধ করেছেন। নবীজী পর্দা করার পর তাঁর বাণী ‘আনা মদিনাতুল ইলম ওয়া আলীউন বাবুহা’ অনুযায়ী বেলায়তের মালিক মওলা আলী শেরে খোদা। যুদ্ধে জয় যখন সমাগত তখন পবিত্র কুরআন বর্শাবিদ্ধ করে যখন সন্ধি প্রস্তাব দেয়া হল তিনি কিতাবুল্লাহ যা মুসলিম সমাজে একতার প্রতীক তার সম্মানে নিজের জয়কে প্রত্যাখান করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নৈরাজ্য বন্ধের জন্য সন্ধি করলেন।

ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী ইয়াজিদ ও তার দোসরদের সাথে সন্ধি না করে ইমাম মাওলা হুসাইন সত্যিকার খেলাফত ও ন্যায়বিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজ ও নিজ পরিবারের সদস্যবৃন্দের আত্মত্যাগের মাধ্যমে কারবালা প্রান্তরকে রঞ্জিত করে অন্যায়কে বাঁধা দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়েছেন।

মানব নিয়ে পরিবার, পরিবার নিয়ে সমাজ, সমাজ নিয়ে দেশ, দেশ নিয়ে পৃথিবী। মানবের নিজের নফসের প্ররোচনা দূর করতে যুগে যুগে নবীরসুলগণ, অলীগণ তাজকিয়ায়ে নফসের শিক্ষা দিয়েছেন। বেলায়তের ধারায় এ মুর্শিদ বা দীক্ষাগুরুর গুরুত্ব অনেক। ইমামে আযম আবু হানিফা তার মুর্শিদ আওলাদে রসুল (দঃ) ইমাম জাফর সাদেকের বেলায়তের প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি নুমান যদি আমার দুবছর আমার মুর্শিদ জাফর সাদেকের তত্তাবধানে না থাকতাম, আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।’

হেরা পর্বতের গুহায় মোরাকাবা মোশাহেদার মাধ্যমে আল্লাহ দয়াল নবীকে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবানের জন্য কিতাব ও হিকমত (বিশেষ উপায়) দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে ‘উদউ ইলা সাবিলে রাব্বিকা বিল হিকমা ওয়া মওজি আতাল হাসানা’ অর্থাৎ মানুষকে আহবান করুন আল্লাহর দিকে বিশেষ উপায়ে ও সুন্দর কথার মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে (নবীকে) সুমহান চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছি’। সহীহ হাদীসে বর্ণিত ‘একজন মৃত ইয়াহুদী ব্যক্তিকে নবীজীর সম্মুখ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়া, এবং সাহাবাদের প্রশ্নের উত্তরে তাকে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান’ সহনশীলতা, পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে, উদারতার মাধ্যমে ইসলামে দাখিল করা ও সমাজে সম্প্রীতি স্থাপনের অনন্য নজীর। তেমনি করে বাবা শাহজালাল, শাহ পরান, গাউছুল আজম বাবা ভান্ডারীসহ অনেক অলীকে দুর্গম পর্বতে, অরণ্যে মোরাকাবার মাধ্যমে মানবতাকে সহজে আল্লাহমুখী করার উপায় লাভ করতে দেখা যায়। গাউছুল আযম হযরত কেবলা (কঃ), গাউছুল আযম বাবাজান কেবলা (কঃ) হাজারো বির্ধমীকে আল্লাহ, তাঁর রসূল করিম ও উলিল আমর (অলীগণের) প্রতি বিশ্বাস আনয়ন করিয়ে তাদের আচার (ধর্মকে) পরিবর্তন করেন।

খাজা গরীবে নেওয়াজ, পৃথ্বিরাজের অনাচারের বিরুদ্ধে, বাবা শাহজালাল গৌর গোবিন্দের অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত করে ক্ষমতা নিজেরা দখল করেননি, পরিচালক রাষ্ট্রপ্রধানদের স্রষ্টাপ্রদত্ত নৈতিকতার বাণীশিক্ষা দিয়ে সমাজে ন্যায়নীতি সুবিচার সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইন্নাল হাসানাতি ইউজহিবু নাস সাইয়্যাই’। একসময় গান বাজনার নামে অবৈধ যৌনতার, উশৃঙ্খলতার চর্চাকারী সূর প্রেমিক মানবতাকে সামা বা আল্লাহ, আল্লাহওয়ালদের শান সমন্বিত কালাম প্রতিস্থাপন করে সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের মহব্বত ও মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বাতায়ন খোলায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব হলেন খাজায়ে গরীবে নেওয়াজ, নিজামউদ্দিন মাহবুবে এলাহী, গাউছুল আযম আহমদউল্লাহ, গাউছুল আযম গোলামুর রহমান প্রমুখ বেলায়তের মালিকগণ।

বেলায়তের দরবারগুলোতে খানকাহ, মাজার, লঙরখানার মাধ্যমে অনাশ্রিতের আশ্রয়স্থল এবং তবরুক খাওয়ানোর মত উত্তম কাজ নিজেরা করে, আশেকানদেরকে এ ব্যপারে অনুপ্রাণিত করে দুই ঈদের মেহমানদারির খুশি বন্টনের ন্যায় সমাজে সম্প্রীতি, শান্তি আনার চেষ্টা লক্ষ্যণীয়।

ইরশাদ হয়েছে, ‘রাব্বানা ওয়াবআস ফিহিম রাসূলাম মিনহুম য়াতলু আলাইহিম আয়াতিকা ওয়া যুআল্লিমুহুমুল কিতাব ওয়াল হিকমা ইন্নাকা আনতাল আজিজুল হাকীম’। ইরশাদ হয়েছে, ‘বাল্লিগ মা উনজিলা ইলায়হে মির রাব্বিক।’ নবীর কিতাবের শিক্ষা, হেকমত, প্রজ্ঞা, ধর্মচর্চা, অন্তঃকরণ পবিত্রকরণ ও ধর্ম ও শান্তি প্রচারের জন্য বেলায়তের মহান অলীগণ খানকাহ, মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর সকল বান্দা ও নবীর উম্মতের জন্য ইসলামের আলো সহজভাবে নিয়ে সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন ও বর্তমানেও রাখছেন।

আল্লাহওয়ালাগণ তাদের জন্য ভক্ত অনুরক্তদের আনীত হাদীয়া অকাতরে মানবের তরে দান করে, আল্লাহর নির্দেশ ‘আসসাদকাতু য়ুতফাউল বালা’ অর্থাৎ দানের মাধ্যম মুসীবত দূর হয় এ বাণী বাস্তবায়ন করেন। তাদের অনুকরণে আজকে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ সহ বিভিন্ন অলীর দরবারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষকে স্বনির্ভর করার জন্য, মানবতার সেবামূলক খাতে দান করে এবং আশেকানে আউলিয়াগণকে যাকাতসহ, নফল দান সদকার মাধ্যমে যাতে সমাজের শোষিত, দারিদ্র নিপীড়িত, জনবলকে সবল করে সুখী শৃঙ্খল, সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে সেভাবে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। বেলায়তের মালিক অলিগণের অনুসরণ সে সর্বোপরি সূরা ফাতিহার বাণী। সিরাতুল মোস্তাকিম (সরল, সত্য পথ) এবং সেই পথ সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলায়হিম (যারা আপনার পথে প্রিয় অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়েছে) তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মালিক আমাদেরকে আল্লাহর আনুগত্য, নবী পাকের আনুগত্য ও উলিল আমর অলীগণের আনুগত্যের মাধ্যমে নিশ্চয়ই মহান সফলতা দান করবেন। (আমিন)

লেখক: প্রাবন্ধিক; সাজ্জাানশীন আওলাদে রসুল (দঃ) আওলাদে গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারী (কঃ), মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুঃখের সাথে ঘরবসতি তবুও গাইতে হবে জীবনের জয়গান
পরবর্তী নিবন্ধড. সুনীতিভূষণ কানুনগো : এক নিভৃতচারী ব্রাত্যসাধক