বেলচা-টুকরির পরিবর্তে শ্যালো মেশিনে ভূ-গর্ভস্থ বালু উত্তোলন

ইজারার শর্ত লঙ্ঘন, উত্তর হারবাংয়ে ভাঙনের মুখে ফসলি জমি-ছড়ার তীরের বসতি

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া | শনিবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উত্তর হারবাংয়ের ওপর দিয়ে প্রবহমান পার্বত্য অববাহিকার হারবাং ছড়ার দুই স্থানকে বালু মহাল হিসেবে ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। শর্ত রয়েছেছড়ার তলদেশ থেকে বেলচা ও টুকরি দিয়ে বালু সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু সেই শর্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রশাসন ও বনবিভাগের নাকের ডগায় ইজারাদার হারবাং ছড়া ও তদসংলগ্ন ফসলি জমির আটটি স্থানে শ্যালো মেশিন বসিয়ে প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। অবৈধ পন্থায় প্রতিমাসে কোটি টাকার এই বালু বাণিজ্যের কারণে কপালে হাত উঠেছে কৃষক এবং ছড়ার তীরে বসবাসকারী কয়েকশত পরিবারের।

ভুক্তভোগী কৃষক ও আতঙ্কিত পরিবারগুলোর অভিযোগইজারাদার শর্ত না মেনে অননুমোদিত স্থান থেকে শ্যালো মেশিনে ভূগর্ভস্থ বালু তুলে ফেলায় ছড়ার তীরে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। একইসাথে ফসলি জমিতে ভূমি ধস হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এসব কারণে তাদের মাঝে উদ্বেগউৎকণ্ঠা এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও প্রশাসন বা বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ইজারাদার পরিবেশ বিধ্বংসী এই অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে প্রতিমাসে বালু বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ।

কক্সবাজার জেলা ও চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উত্তর হারবাং এলাকায় সরকারিভাবে জেলা প্রশাসনের দুটি বালু মহাল চালু রয়েছে। এক বছর মেয়াদে ওই বালু মহাল দুটি চলতি বছরের এপ্রিল মাসে (১৪৩২ বাংলা সনের জন্য) ইজারা দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ওঠেছে, বালুমহাল ইজারাদারের লোকজন সরকারের বালু মহাল ইজারা নীতিমালা লক্সঘন করে সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে দুই পয়েন্টের পারমিট নিয়ে বর্তমানে উত্তর হারবাংয়ের হারবাং ছড়া খালের সাত কিলোমিটার অংশে ৬ স্থানে এবং তদসংলগ্ন ফসলি জমিতে শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু লুট করা হচ্ছে।

সরজমিন দেখা গেছে, অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলনের কারণে উত্তর হারবাং এলাকার কয়েকশ একর ফসলি জমি ভেঙে খালে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে জমির রকমারি সবজি ক্ষেত ও ফসল ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে, উদ্বেগআতঙ্কে ভুগছেন স্থানীয় কৃষকেরা। পাশাপাশি ভাঙনের কবলে পড়েছে খালের দুই তীরের বিপুল বসতবাড়ি। অপরদিকে উত্তোলন করা বালু পরিবহনে মাত্রাতিরিক্ত ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে ভেঙে যাচ্ছে ওই এলাকার গ্রামীণ ও বনাঞ্চলের ভেতরের সড়কগুলো।

এলাকাবাসী জানিয়েছে, সরকারি দুটি বালু মহালের দোহাই দিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন, বিএনপি নেতা দাবিদার খানে আলম, রাজিব, রাসেল ও ফারুক আহমদের নেতৃত্বে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা বালুদস্যু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গত জুলাই মাস থেকে হারবাং ইউনিয়নের উত্তর হারবাং সাবানঘাটা, সেগুনবাগান, গয়ালমারা, কাটতলী, কোরবানিয়া ঘোনা, করমুহুরী পাড়ার সালাহউদ্দিন আহমদ ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা এবং পাহাড় ঘেঁষা ছড়াখালের অন্তত ৮ পয়েন্টে শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। তারা প্রতিদিন দিবারাত্রি বালু উত্তোলন করে ভারী যানবাহনযোগে চট্টগ্রাম শহর এবং উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে মাসে কোটি টাকার বাণিজ্য চালাচ্ছে।

সরজমিনে জানা গেছে, কক্সবাজারচট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের করমুহুরীপাড়া গ্রামীণ সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ি জনপদ। এই জনপদে পাহাড়ি ছড়ার অন্তত ৮ পয়েন্টে বসানো হয়েছে বালু উত্তোলনে একাধিক শক্তিশালী শ্যালো মেশিন। অথচ উত্তর হারবাং এলাকায় চলতি বছর সরকারিভাবে জেলা প্রশাসন থেকে বালু মহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে দুটি।

উপজেলা ভূমি অফিস জানায়, জেলা প্রশাসন কর্তৃক বালু মহাল ইজারা সংক্রান্ত সরকারি নীতিমালা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ইজারা দেওয়া নির্ধারিত এরিয়া থেকে বালু উত্তোলন করতে হবে। বালু উত্তোলনে শ্যালো মেশিন বা ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। বালু উত্তোলন করতে হবে শ্রমিক দিয়ে বেলচা কেটে টুকরিতে করে। মহালে মজুদ করার পর সেখান থেকে বিক্রি করবে ইজারাদার।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রূপায়ন দেব বলেন, সরকারি মহালের বাইরে গিয়ে একাধিক পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না। নীতিমালায় বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা আছে। যদি একাধিক পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করার অভিযোগটি তদন্তে পাওয়া যায়, তাহলে এই কাজের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অপরদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের (চুনতি ও পদুয়া রেঞ্জ) সহকারী বন সংরক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে যদি বালু উত্তোলন ও পরিবহনের জায়গা বনভূমিতে পাওয়া যায় তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এছাড়া হারবাংয়ের ওই এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের কারণে বন ও পরিবেশের কোনো ধরনের ক্ষতি হচ্ছে কীনা তা দেখভাল করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনের টিকিট জালিয়াতি ঠেকাতে হার্ডলাইনে প্রশাসন
পরবর্তী নিবন্ধগণতান্ত্রিক উত্তরণকে কোনোভাবেই রুদ্ধ করা যাবে না : সালাহউদ্দিন