বেদনার অশ্রুবিন্দু

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

রাসেল একটি নাম নয় একটি ইতিহাস। একটি আবেগ, একটি প্রতিবাদ। রাসেল আমাদের ভালোবাসা ও ভালোলাগার অনন্য এক নাম। বিশ্বের অসংখ্য নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক স্লোগান।
রাসেল! কিংবা শেখ রাসেল! নামটার মাধ্যমেই জ্বলে উঠে সমগ্র বাংলাদেশ। আমি মায়ের কাছে যাবো। এক বেদনামণ্ডিত শিশুকণ্ঠের করুণ আর্তি শ্রাবণের গহীন রক্ত পার হয়ে আমাদের কানে তীব্রভাবে আঘাত করে। আঘাতের পর আঘাত। আমাদের স্নেহের ভুবনখানি আবেগে পাথর হয়ে যায়। হায়! কচি প্রাণের ছোট রাসেল সেই ভয়ংকর রাতের বিভীষিকার মধ্যে মা-বাবা, দুই ভাই ও ভাবির লাশ দেখে কেমন করে দাঁড়িয়েছিল সে দিন? অমন স্নিগ্ধ দুটি চোখের দৃষ্টিতে কিভাবে সহ্য করেছিল মেশিনগান আর রাইফেলের মুহূর্মুহূ গুলির ভয়ানক শব্দ। কী অনুভব করেছিল যখন তিতির ছানার মতো তাঁর ছোট বুকটা বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার পাষাণ পাথরে?
যতদিন বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি- ততদিন রাসেল রাসেল ডাক পাড়ি-আমাদের চেতনার পেণ্ডুলামে আঘাতের পর আঘাত করে যাবে! আমাদের মানবিক বোধ আর ব্যর্থতার ইতিহাস নাড়া দিয়েই যাবে-বলবে : বলো, বাংলাদেশ-আমার কী অপরাধ ছিল? বলো, মাটির পৃথিবী কেন আমার নিষ্পাপ বুকে ওরা গুলি চালিয়েছিল?
এ প্রশ্ন কেবল ৩২ নম্বরের রাসেলের নয়, পৃথিবীর সকল নিপীড়িত রাসেলের। অনেক প্রশ্নের উত্তরে আছে শুধু মৌন শোক, বুকভরা বেদনা আর অনিঃশেষ আর্তি। এসব নিয়েই আমরা বাঙালিরা প্রতি ভোরে জেগে উঠি। প্রতিটি আবির-রাঙা সন্ধ্যায় রাসেলকে ডাকি রাসেল সোনা, তোমার শান্তির পায়রারা আকাশে মেলছে ডানা…। (রাসেলের জন্য ভালোবাসা, বাংলা একাডেমি, প্রসঙ্গকথা)
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলের নাম শেখ রাসেল। রাসেলের জন্ম দেশের অন্য সাধারণের ন্যায় ছিল। সে দিনের পরিবেশ, সে দিনের আবহাওয়া সবই ছিল সাধারণ। সে দিন সকালে অন্য দিনের ন্যায় রোদ উঠে ছিল, পাখি ডেকে ছিল। সাধারণ হয়ে জন্মেও রাসেল আজ অনন্য অসাধারণ। তার ছোট কচি বুকে ধারণ করেছিল ঘাতকের অসংখ্য বুলেট।
ছোট ছেলে রাসেল বাবার চোখের মণি ছিল। রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে বাবাকে ছাড়া। বেশিরভাগ সময় দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসার কারণে, রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে শাসকদের পথের কাঁটা ছিলেন তিনি। সে কারণে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারেই ছিল তাঁর প্রকৃত আবাসস্থল। ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাবাকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট রাসেলকে সব সময় বেদনার্ত ও শোকার্ত করে রাখত।
‘স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু মুক্ত মানুষ হয়ে স্বদেশে ফিরে এলে শেখ রাসেল তাঁর আব্বাকে বেশি করে কাছে পেতে শুরু করেন। এ সময়ে দেশ বিদেশে পিতা শেখ মুজিব রাসেলকে তাঁর সফরসঙ্গী করেছেন। রাসেল পিতার সঙ্গে দেশের বাইরে যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জাপান, সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ করেন।
জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক নাগিসা ওসিমা ১৯৭২ সালের ১৩ মে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘একটি ছোটো ছেলে সবসময় আপনাকে ঘেঁষে থাকে। এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময়ও ও আপনার পিছু ছাড়ে না। ব্যাপারটি আমাদের বেশ লেগেছে। আচ্ছা, নাম কী ওর? কত বয়স হলো ছেলেটার?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু জানান, ‘ও রাসেল, শেখ রাসেল। এবার সাতে পড়েছে।’ নাগিসা ওসিমার পরের প্রশ্ন ছিল, ‘ও তো আপনার পিছু ছাড়ে না দেখছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ও আমাকে সঙ্গ দেয়। প্রায়ই আমার সাথে থাকতে ভালোবাসে, তবে সবসময় নয়। দাপ্তরিক কাজের সময় অবশ্য থাকে না। অন্য সময় থাকে, বিভিন্ন জায়গাতে যায় আমার সাথে। এর একটা কারণ আছে। ওর বেড়ে ওঠার সময়টা আমার কেটেছে জেলে। বারবার জেলে যেতে হয়েছে। ওর যখন পনেরো মাস বয়স, জেল হয়ে গেল আমার তিন বছরের জন্য। বের হওয়ার পর আবারও জেলে যাই দেড় বছরের জন্য। ও আমার সাথে সাথে থাকে, কারণ ওর মধ্যে ভয় কাজ করে। এই বুঝি বাবা আবার জেলে চলে যাবে! বাবাকে চোখের আড়াল করতে চায় না বলেই এই কাছে থাকা’।
৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে পাশের ৬৭৬ নম্বর ‘সারায়ে খাম’ বাড়িটির সাথে এক আত্মিক বন্ধন ছিল। এ বাড়ির মালিক ডা. আব্দুস সামাদ খান চৌধুরী। তিনি ১৯৬১ সাল হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিবেশী। ডা. সামাদ খান সাহেবের চার ছেলে। তাঁর মধ্যে আব্দুল আওয়াল খান চৌধুরী ইমরান এবং আদিল ছিল রাসেলের বন্ধু ও খেলার সাথি। আবদুল আওয়াল খান চৌধুরী ইমরান আবেগ ঘন অশ্রুসজল চোখে বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে রাসেলের স্মৃতিচারণ করেন।
‘তখন দুপুর ২.৩০ টার মতো বঙ্গবন্ধু শোবার ঘরে রাসেল শুয়ে আছে। আমি চুপি চুপি দোতলায় উঠে ঈশারায় রাসেলকে ডাকছি। কারণ রাসেলের জন্য বঙ্গবন্ধু ফ্রান্স হতে একটি খেলনার ট্রেন এনেছিল। যা জোড়া লাগিয়ে চালানো যেতো এবং ইঞ্জিনের উপরে ধূয়া উঠতো। সেটির প্রতি আমার খুব আগ্রহ। সেটি রাখা থাকতো রেকের নীচে। যেখানে বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া গিয়েছিল সে রেকের নীচে ট্রেনের খেলনাটি ছিল। এটি রাসেল জোড়া লাগিয়ে বাইরে নিয়ে আসতো। প্রতিদিন রাসেল ছিল আমাদের খেলার সাথি। আমার চোখের উপরে একটি কাটা দাগ রয়েছে যা রাসেলের সাথে খেলতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল।”
“রাসেল ছোটবেলায় খুবই হ্যাংলা-পাতলা ছিল। রাতে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে ঘুমাত। তাকে দেখে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের ছেলে মনে হতো না। আমরা সহজ সরল রাসেলকে বন্ধু বা খেলার সাথী হিসেবে ট্রিট করতাম। রাতে সে এভাবেই ঘুমিয়ে ছিল। যখন গোলাগুলি শুরু হয়, তখন তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে প্যানিক্‌ড হয়ে যায়। একজন পুলিশ, জানি না তিনি ওখানে পুলিশ প্রধান ছিলেন কি না, রাসেলকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন। যে গার্ডরুমটা আছে, যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিউটি করেন, রাসেলকে সেখানে ঢোকানোর চেষ্টা করছিলেন। রাসেল কাঁদছিল। বলছিল, মায়ের কাছে যাব। ওই পুলিশকে যখন গানপয়েন্টে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এ কে? তখন সে বাধ্য হয়ে বলেছিল, সাহেবের ছেলে।”
“মায়ের কাছে যাবা? আমার সঙ্গে আসো। এ কথা বলে সে তাকে নিয়ে যায় তিনতলায়। দোতলায় তারা অলরেডি বেগম মুজিবকে খুন করেছে। তিনতলায় তার দুইটা নতুন ভাবি। ভাবিদের পাশে দাঁড় করিয়ে ভাবিদের দিকে ব্রাশফায়ার করেছে কোমর বরাবর। রাসেলের মাথায় গুলি লেগেছে। হাইট অনুযায়ী সে ভাবিদের কোমরের কাছাকাছি উচ্চতায় দাঁড়ানো ছিল। শুনেছি, তার মাথার খুলি থেতলে দেয়ালের সঙ্গে আটকে ছিল। মগজ ছিটকে পড়েছিল। এ রকম দৃশ্য সম্ভবত আবদুল দেখেছে।” বঙ্গবন্ধুর অফিস সহকারী, বোধহয় মোহিতুল। তিনি বলেছেন রাসেল তাঁর সঙ্গে ছিল। একেক জন একেক রকম বলেন, হতে পারে, আমি তো দেখিনি। রাসেল ওয়াজ স্পট ডেড। (জাতির পিতা, জন্মশতবর্ষে চট্টগ্রামের শ্রদ্ধাঞ্জলি, প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু, সম্পাদনা : নেছার আহমদ)
রাসেল বঙ্গবন্ধুর সন্তান তাঁরই রক্ত বইছে শেখ রাসেলের শরীরে। একাত্তরের পরাজিত বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনাকে মুছে ফেলার জন্য বাঙালি জাতিকে অভিভাবক শূন্য করার জন্য ঘটিয়েছিল এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড। পার্থিব কোনো কালিমা ছোট রাসেলকে স্পর্শ করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন তাঁর জীবন প্রদীপকে নিভিয়ে দিয়েছিল। রাসেল বীর বাঙালির ইতিহাস আর লাল-সবুজের পতাকার মাঝে মিশে আছে।
শেখ রাসেল নামটি অন্তহীন বেদনার এক মহাকাব্য। ক্ষমা করো রাসেল। বাঙালি জাতি এ হত্যাকাণ্ডের দায়ভার আজীবন বয়ে বেড়াবে। বাবা-মার স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে রাসেল হয়তো ব্রাট্টান্ড রাসেলের মতোই বিশ্বখ্যাত হবে। রাসেলের বুদ্ধিদীপ্ত বাক্‌ভঙ্গি ও চালচলন তাঁদের মনে তেমনই স্বপ্নই গেঁথে দিয়েছিল। সদাহাস্য ফুটফুটে রাসেল এক সময় হয়ে ওঠে বাবার রাষ্ট্রীয় সফরের আনন্দসঙ্গি। রাসেলকে তিনি দিতে চেয়েছিলেন জীবনের বিশ্বস্ত পাঠ। কিন্তু ৭৫ এর ট্র্যাজেডি বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে চিরতরে শেষ করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটারি হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শেখ রাসেলের আলোকসুষমাদীপ্ত সেই সহাস্য মুখটি আমরা কী করে ভুলি! ১৯৬৪ এর ১৮ অক্টোবর জন্ম নেওয়া শেখ রাসেল স্বদেশমগ্ন বাঙালির কাছে আজও এক অন্তহীন শোকের নদী।
শেখ রাসেলকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি’র ব্যানারে ১৪ অক্টোবর হতে ১৮ অক্টোবর ২০২২ চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি ‘শেখ রাসেল ছোটোদের বইমেলা ও শিশুসাহিত্য উৎসব’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে ‘ভালোবাসায় শেখ রাসেল’ শীর্ষক বিশালাকার একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যা এক কথায় অভাবনীয়।
৫ দিন ব্যাপী নানান আয়োজনে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার শিশুসাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে ‘শেখ রাসেল ছোটোদের বইমেলা’ ইতিহাসে অনন্যসাধারণ স্থান করে নিবে বলে আমি মনে করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘আমি মায়ের কাছে যাবো’
পরবর্তী নিবন্ধরাসেল মায়ের পাশেই আছেন