বেগম রোকেয়া মহীয়সী আলোকিত নারী

শ্রদ্ধাঞ্জলি:

সৈয়দ দিদার আশরাফী | সোমবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

নারীদের যাপিত জীবনের বৈষম্য কুসংস্কার ও অন্ধকার পথকে মাটি ছাপা দিয়ে আলোকিত করেছিলেন একজন মানুষ। তিনিই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। প্রসঙ্গত বেগম রোকেয়া নারীদের জাগিয়েছে। নারী সভ্যতাকে জাগরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা পাঠদানের আগ্রহ করে তুলেছিলেন এই মহিয়সী নারী। নারীদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ, বৈষম্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রীতিমত আন্দোলন ও সংগ্রামের আওয়াজ তুলেছিলেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্বপ্ন দেখতেন নারী সমাজ শিক্ষায় সুশিক্ষিত হলে দেশ ও জাতি শিক্ষিত হয়ে ওঠবে একাগ্র নির্ভরশীল। পরনির্ভরশীলতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পরতে পরতে এদেশের নারী সমাজকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন শিক্ষা, অধ্যবসায়, মেধা ও ত্যাগের বিকল্প নেই। তিনি নারীদেরকে একাগ্রচিত্তে নিজের পায়ে দাঁড়ানো শপথ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন, এছাড়া সমষ্টিগতভাবে নারীদের নিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করান।

দেশের শীর্ষ পথ থেকে শুরু করে নিম্ন স্তর পর্যন্ত। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি দাপটের সাথে কাজ করছে এবং স্বাবলম্বী হচ্ছে। দেশে বিদেশে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীরা স্ব স্ব জায়গায় খুব প্রশংসিত। নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক নাম হল রোকেয়া খাতুন ওরফে রুকু। ১৮৮০ সালে ১৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। তার পিতার নাম জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার। মাতার নাম রাহতুন্নেসা চৌধুরানী। সেকালের আর দশটা মুসলিম পরিবারের মেয়েদের মত বেগম রোকেয়ার পরিবারের মেয়েরাও বড় হয়েছেন কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন ও পর্দাপ্রথার অন্তরালে। তার পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। লেখাপড়া শেখার দুর্দমনীয় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বেগম রোকেয়া তার কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ তিনি পাননি। পাঁচ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া তার মায়ের সঙ্গে চলে যান কোলকাতায়, তার বড় বোন করিমুন্নেসা খানমের শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে এক মহিলা শিক্ষিকার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। প্রথম যে দিন তিনি শিক্ষিকার সামনে বের হন। সেদিন তার মা তাকে মারতে পর্যন্ত উদ্যত হয়েছিলেন। এরপর তাদের দেশে ফিরে যেতে হয়। বাড়িতে দিনের বেলায় লেখাপড়া শেখার সুযোগ নেই। দিনের শেষে রাত্রির গভীর অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে ছোট্ট রোকেয়া বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের’র কাছে পাঠ গ্রহণ করতে লাগলেন, তার কাছে শিখলেন বাংলা ভাষা। শিক্ষা অর্জনে এহেন প্রতিকূল পারিবারিক পরিস্থিতিতে যার পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু সে শিক্ষানুরাগী বেগম রোকেয়ার ১৬ বছর বয়সে বিবাহ হয়। ভাগলাপুর নিবাসী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে (১৮৯৭)। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। উদার, শিক্ষানুরাগী ধীর ও গম্ভীর স্বভাবের কুসংস্কারমুক্ত মননের অধিকারী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে আজন্ম শিক্ষানুরাগী বেগম রোকেয়ার বিদ্যাচর্চা ও প্রতিভার বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ যাতে নিশ্চিত হয় সে কথাটি ভেবে বড় ভাই ইব্রাহিম স্যারের রোকেয়ার সাথে আলোচনা করেই এই বিবাহ স্থির করেন। বেগম রোকেয়া নিজেই তার স্বামীর অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। এভাবে, আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী অনুকূল না হইলে আমি কখনোই প্রকাশ্যে সংবাদপত্রে লিখতে সাহসী হইতাম না । ১৯০৯ সালে ৩ মে স্বামীর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া পুরোমাত্রায় সমাজসেবা সমাজে নারী শিক্ষার বিস্তার ও সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সালে ১৬ মার্চ কোলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল উর্দু প্রাইমারী স্কুল স্থাপন করেন। ১৯১৭ সালে এই স্কুল মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুল ও ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়। আমৃত্যু বেগম রোকেয়া এই ছাত্রী যোগাড় করতেন নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও দক্ষতা ছিল তুলনাহীন। ১৯০৯ সালে ১ অক্টোবর মাত্র ৫টি মেয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে বেগম রোকেয়া ভাগলপুর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল স্থাপন করেন। পরে এই স্কুলটি কলকাতায় ১৯১১ সালে ১৬ মার্চ স্থানান্তরিত হয়। বেগম রোকেয়া জীবনকালে নিখিল ভারত মুসলিম সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনোল এর সদস্য ডা. লুৎফুর রহমান প্রতিষ্ঠিত নারী তীর্থ’ এর কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনটি যৌনকমী নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করত। ১৯২০ সালে কোলকাতার স্বাস্থ্য ও শিশু প্রদর্শনীতে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯২৫ সালে আলীগড় মহিলা সমিতির সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে সভানেত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কোলকাতার আঞ্জুমানে ইসলাম মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নারীর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার নেতৃত্বে এই সমিতি তৎকালীন মুসলিম নারী সমাজের ক্ষমতায়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। তার পাশাপাশি তিনি লেখনির মাধ্যমে সৃষ্টি করে গেছেন নারী জাগরণের প্রণোদনা দানকারী রচনা সমূহ। বেগম রোকেয়ার মানস সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আধুনিকতা। এই আধুনিক কালের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য নয়, বিচার্য যুগ ধর্মের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতার প্রশ্নে। তার মধ্যে দেখা যায় বিজ্ঞান মনস্কতা, যুক্তিবাদিতা, ইহজাগতিকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, মানবতা প্রভৃতি মাত্রার সন্নিবেশিত প্রয়াস। এই প্রয়াস পুরাতন হবার নয়। কালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীনতা তাকে সংকীর্ণ করতে পারেনি। বেগম রোকেয়া ঐ সমস্ত মনীষীদের অন্তর্ভুক্ত যাদের চিন্তাবিশ্বাস, বোধ তাদের কর্মে প্রতিফলিত হয়। তিনি নারী মুক্তির পথে যে সব অন্তরায় উদঘাটন করেছেন সে সব মন্তরায়কে দূরীভূত করার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন এবং নারীর জন্য যে সমাজে ব্যবস্থার কথা স্বপ্নে লালন করতেন তা বাস্তবায়নে সর্বদা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম নারী সমাজ নারী শিক্ষা প্রবর্তনে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেন বেগম রোকেয়া। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এ মহীয়সী মহিলাই ১৯০৯ সালে ১ অক্টোবর মাত্র ৫টি মেয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে রোকেয়া ভাগলপুর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে স্কুলটি ১৯১১ সালে ১৬ মার্চ কোলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু পারিবারিক অসহযোগিতার কারণে তিনি বেশি দিন ভগলপুর থাকতে পারেননি। অন্যদিকে বেগম রোকেয়ার কালে মুসলমান মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের জন্য স্কুলে পাঠানো ছিল রীতিমত সাহসের ব্যাপার। সে কারণে বেগম রোকেয়ার স্কুলে প্রথম দিকে কেবল অবাঙ্গালি মেয়েরাই পড়াশুনা করত। কিন্তু পরবর্তীকালে বেগম রোকেয়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুসলমান অভিভাবকদের নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝাতেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এর ফলে বেগম রোকেয়ার প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় ক্রমশ বাঙালি মেয়েরা বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়তে শুরু করেন। নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বেগম রোকেয়া বলেন, মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে যাতে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীররূপে পরিচিত হতে পারে। তিনি আরও বলেন শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই নয় বালিকাদিগকে নানাভাবে দেশ ও জাতির সেবা এবং পরপোকারে ব্রতে উদ্বুদ্ধ করে তোলাও আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। উনবিংশ শতকের বাঙালির সমাজ সংস্কারমূলক চিন্তায় বেগম রোকেয়া অবদান ও চিন্তা অন্যান্য পুরুষ সমাজ দার্শনিকদের চিন্তার সাথে সমানভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ বেগম রোকেয়ার সমস্ত রচনা ও কর্মের পিছনে আছে এদেশের পশ্চাদপদ সমাজের উন্নয়ন। সমাজ দার্শনিক হিসেবে বাংলা নবজাগরণী সকল চিন্তাবিদদের মত রোকেয়ার চিন্তার লক্ষ্য সমাজ উন্নয়ন হলেও রোকেয়া উন্নয়ন দর্শন ছিল অনেকের চেয়ে ভিন্ন। কারণ রোকেয়াই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অপরিহার্য রূপে আলোচনার সামনে নিয়ে আসেন।

সমাজ উন্নয়নে রোকেয়ার চিন্তা ছিল সামগ্রিক। সমাজের খণ্ডিত একটি অংশ (পুরুষ জাতি) নিয়ে যে টেশসই উন্নয়ন সম্ভব নয় একথা বেগম রোকেয়া তার সমগ্র রচনাতেই উচ্চ কণ্ঠে বলে গেছেন। অর্থাৎ সমাজ উন্নয়নে বেগম রোকেয়া পুরুষের সাথে সাথে নারী জাতির উন্নয়নের উপর সমান গুরুত্ব প্রদানের আহবান জানান। বেগম রোকেয়া বঙ্গীয় মুসলমান নারীর উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কিছু পথ দেখিয়ে গেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ভোর ৫টায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রসঙ্গত, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আজন্ম স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে অবশ্যই এদেশের নারী সমাজকে শতভাগ শিক্ষিত হতে হবে এবং স্ব স্ব জায়গায় নারীদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে তবেই সম্ভব হবে একটি উন্নতশীল রাষ্ট্র গড়া। লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুঠোশিক্ষকের ভূমিকায় চ্যাটজিপিটি
পরবর্তী নিবন্ধইনফোডেমিক ভাইরাসে আক্রান্ত ভারতীয় গণমাধ্যম