বেগম খালেদা জিয়া : বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস

মনোয়ার হোসেন রতন | বুধবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

ইতিহাসের পাতায় এক অনিবার্য উপস্থিতি: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কেবল ক্ষমতার পালাবদলের ধারাবিবরণী নয়; এটি মানুষের আশানিরাশা, রক্তাক্ত সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও গণতন্ত্র রক্ষার এক দীর্ঘ ও জটিল আখ্যান। এই ইতিহাসের পাতায় যাঁদের নাম অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হবে, বেগম খালেদা জিয়া তাঁদের অন্যতম বরং অন্যতম প্রধান।

তিনি কোনো ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক চরিত্র নন; তিনি একটি সময়, একটি রাজনৈতিক ধারা এবং একটি দর্শনের প্রতীক। খালেদা জিয়াকে বোঝা মানে কেবল একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বোঝা নয়; বরং বোঝা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সবচেয়ে উত্তাল, সংঘাতপূর্ণ ও নির্ণায়ক অধ্যায়গুলোর একটি। ইতিহাসে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের বাদ দিলে সময়ের ব্যাখ্যাই অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। খালেদা জিয়া ছিলেন ঠিক তেমনই একজন রাষ্ট্রনায়ক।

নীরবতা ভেঙে নেতৃত্বে উত্তরণ: অনিচ্ছুক কিন্তু অনিবার্য যাত্রা খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন কোনো পরিকল্পিত ক্ষমতালোভের ফল ছিল না। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর, এক শোকাহত পরিবার, বিপর্যস্ত রাষ্ট্র এবং দিশাহীন জাতির সামনে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন এক অনিবার্য দায়িত্ব নিয়ে।

তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন প্রস্তুত হয়ে নয়, কিন্তু টিকে ছিলেন অটল দৃঢ়তা, আত্মমর্যাদা ও নীরব সাহস দিয়ে।

একজন গৃহিণী থেকে জাতীয় নেত্রী হয়ে ওঠার এই রূপান্তর শুধু ব্যক্তিগত নয় এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক মৌলিক ও যুগান্তকারী পরিবর্তন। সন্দেহ, অবজ্ঞা ও বৈরিতার দেয়াল পেরিয়ে তাঁকে প্রমাণ করতে হয়েছে নেতৃত্ব লিঙ্গে নির্ধারিত হয় না; নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় সংকল্প, সহনশীলতা ও সময়ের ভার বহনের ক্ষমতায়। এই পথচলায় তিনি ছিলেন অনিচ্ছুক, কিন্তু ইতিহাস তাঁকে করেছে অনিবার্য।

গণতন্ত্র, আপসহীন রাজনীতির মূল দর্শন: খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে ছিল গণতন্ত্র শব্দে নয়, চর্চায়। ক্ষমতার প্রশ্নে সমঝোতা সম্ভব হলেও গণতন্ত্রের প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও আপোষহীন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তনে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসস্বীকৃত। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় অস্ত্র দিয়ে নয়; রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় জনগণের ভোটাধিকার দিয়ে।’

এই বিশ্বাসই তাঁকে বারবার রাজপথে নামিয়েছে, বারবার সংঘাত, নিপীড়ন ও কারাবরণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কারাগারের দেয়াল, অবরোধ কিংবা শারীরিক অসুস্থতা কোনোটিই তাঁর রাজনৈতিক কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারেনি।

তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে এক অবিচল কণ্ঠ, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও দৃঢ় হয়েছে।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী: ক্ষমতার নয়, দায়িত্বের ভার খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে কেবল ক্ষমতার পরিসংখ্যানে বিচার করলে তাঁর নেতৃত্বের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। তাঁর শাসনামলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বহুদলীয় রাজনৈতিক পরিবেশ এবং মতপ্রকাশের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বিস্তৃত ছিল এটি ইতিহাসের নথিভুক্ত সত্য।

তিনি ক্ষমতাকে দেখেছেন রাজকীয় সুবিধা নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হিসেবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে তাঁর সমসাময়িক অনেক নেতার থেকে আলাদা করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষশাসিত রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নারী নেতৃত্বের এক শক্তিশালী ও স্থায়ী প্রতীক। বিশ্ব রাজনীতিতে যখন মার্গারেট থ্যাচার, বেনজির ভুট্টো কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর নাম উচ্চারিত হয়, খালেদা জিয়ার নামও সেই কাতারেই উচ্চারিত হওয়া ন্যায়সঙ্গত।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারসাম্যপূর্ণ, সংযত ও জাতীয় স্বার্থনির্ভর, যা তাঁকে একজন মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত করেছে।

ত্যাগ, নিঃসঙ্গতা এবং ইতিহাসের চূড়ান্ত বিচার খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগের এক দীর্ঘ উপাখ্যান। কারাবরণ, গুরুতর অসুস্থতা, দীর্ঘ নিঃসঙ্গতা এবং অবিরাম রাজনৈতিক আক্রমণ সবকিছুই তিনি বহন করেছেন নীরব দৃঢ়তায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন রাজনীতির বলি হয়েছে বারবার, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস কখনো ভাঙেনি। এখানেই তাঁর চরিত্রের প্রকৃত শক্তি তিনি ব্যক্তি খালেদা জিয়াকে নয়, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

খালেদা জিয়া সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন কোনো বড় নেতাই নন। কিন্তু ইতিহাস ব্যক্তিগত পছন্দঅপছন্দে লেখা হয় না; ইতিহাস লেখা হয় প্রভাব, অবদান ও সময়কে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে। আর সেই মানদণ্ডে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য নাম। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। রাষ্ট্রের ক্ষমতা বদলায়, সরকার আসে যায় কিন্তু কিছু মানুষ ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে যান। খালেদা জিয়া তেমনই একজন রাষ্ট্রনায়ক যাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফারজানা রহমান শিমুর গল্পগ্রন্থ ‘জলের অতলে’ : সমাজের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধগণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা বেগম খালেদা জিয়া : এক অপরাজেয় ইতিহাস