আজ যার কথা লিখবো সেই মেয়েটির নাম বিব্বি। যমজ এক দিদি ছিল তাঁর, নাম জোহরা। মা মুস্তারি বাঈকে সারাদিন পরিশ্রম করতে হয় বাইরে–বাইরে। নাহলে যে ছোটো মেয়েদুটিকে বাঁচাতে পারবেন না তিনি। এদিকে ঘরে–বাইরে শত্রু। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন লক্ষ্মৌর আইনজীবী সৈয়দ আসগর হুসেনকে। কিন্তু কোথায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সৈয়দ সাহেব আর কোথায় তিনি ফৈজাবাদের এক সাধারণ ব্যাপারীর মেয়ে! স্বামীর ঘরে যাওয়া হয়নি কোনোদিন। মেয়েরা পায়নি পিতার পরিচয়। তাও সৈয়দ সাহেব আসতেন প্রথমদিকে, তারপর একদমই বন্ধ করে দিলেন সমস্ত দরজা। মুস্তারির নিজের আত্মীয়দের সঙ্গেও চলছে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। একদিন বাড়ি ফিরে দেখেন ঘরের মেঝেতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে দুই মেয়ে। ফুটফুটে শিশুদের মুখে বিষ তুলে দিয়েছে কেউ বা কারা। বিব্বি সুস্থদেহে হাসপাতাল থেকে ফিরলেও বাঁচানো গেল না জোহরাকে। কিছু টাকা অবশ্য পাঠিয়েছিলেন সৈয়দসাহেব, ফেরত দিলেন মুস্তারি। নিজের লড়াই লড়ে নেবেন তিনি। এক মেয়েকে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন জীবনসংগ্রামে।
দুঃখ, বেদনা যার জীবনে সেই তিনিই আত্মমগ্ন হয়ে গানের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে শান্তি পেতেন। সমস্ত বেদনার রঙ ঢেলে দিতেন তাঁর গানের ধ্রুপদী সুরে।
প্রকৃতির নান্দনিক ছন্দে মাঝে মাঝে ভেঙে গেছে সমস্ত নীরবতা। যাঁর কণ্ঠের এক প্রান্তে ‘রুহি–গুলাবের’ গন্ধমাখা ঠুমরি, দাদরা কিংবা গজলের স্মৃতিসুধা। তারই অন্য প্রান্তে, জমে থাকা বিরহ, বিষণ্নতা আর যন্ত্রণা। আর এ দু’য়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে বিবি আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠার নস্টালজিক ও ট্র্যাজিক কাহিনি।
ঔপনিবেশিক যুগে তথাকথিত অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলোতে কুসংস্কার ঘিরে ছিলো। তার বিরুদ্ধে নারীসত্তার লড়াই–সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠার সত্য–গল্প যা তাঁর জীবনের করুণ অংশ। প্রাচ্য নারীর ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্র ও বিকাশের শিল্পিত সংগ্রামের তিনি একজন আইকন।
বেগম আখতার ১৯১৪ সালের ৭ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আগেই বলেছি, আসগর হুসেন। ছিলেন অভিজাত পরিবারের মানুষ। সেই ভদ্রলোকের তৃতীয় স্ত্রী মুশতারি বেগম।
একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয় বিবিকে। সেই স্কুলে এক দিন অর্থ সাহায্য করতে এলেন গহরজান। সেই গহরজান, যাকে বলা হয় ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। শোনা যায়, স্কুলের প্রবীণ শিক্ষিকা যখন গহরজানকে স্কুল ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, হঠাৎই তাঁর ওড়নায় টান পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখেন, ছোট্ট একটি মেয়ে অবাক হয়ে দেখছে তাঁর বহুমূল্য ওড়নাটি। গহর সস্নেহে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নাম?’ উত্তর দেওয়ার সময় তার কণ্ঠস্বরই গহরজানকে বুঝিয়ে দেয় যে, সে গান গায়। তাঁর কথাতেই বিবি গেয়ে উঠেছিল। অথচ এর আগে বিবি কোনও দিন গান গায়নি। সেই এক কলি গান শুনেই গহর নিশ্চিত হয়েছিলেন, এই মেয়ে এক দিন বড় শিল্পী হবে। ইতিমধ্যে মুস্তারি মেয়ে বিবিকে নিয়ে গয়াতে তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেন। বিখ্যাত উস্তাদ জামির খাঁ–র কাছে সেখানে বিবি তালিম নেওয়া শুরু করে। এমনই এক সময় পাটনায় বন্যা দুর্গতদের সাহায্যার্থে একটি বড় সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে মুস্তারি অনেক কাকুতিমিনতি করে বিবির গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনুষ্ঠানে বছর দশেকের বিবির গান শুনে একটি রেকর্ড কোম্পানি তার গান রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। রেকর্ড হল। কিন্তু, আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি–র সেই প্রথম রেকর্ড বাজারে চলল না। হতাশ মুস্তারি মেয়েকে নিয়ে গেলেন এক পীরের কাছে। তারপরে ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো’ গানটি যখন রেকর্ড হয়ে বেরোল, বিবিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তেরো বছর বয়সে সেই গান তাকে এনে দিয়েছিল ভারত জোড়া খ্যাতি। এরপর বিবি অর্থাৎ আখতারি এলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায়। পাতিয়ালার উস্তাদ আতা মুহম্মদ খানের কাছে শুরু হলো তালিম। প্রথম দিকে আখতারির গান রেকর্ড করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এক বাঙালি সঙ্গীতপ্রেমী, মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ।
চৌদ্দ বছর বয়সে আখতারি যোগ দিলেন থিয়েটারে। প্রথম দিকে বেগম আখতার কিছু হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩০–এর দশকে তিনি ‘এক দিন কি বাদশাহাত’, ‘নল দময়ন্তী’, ‘নাচ রঙ্গ’, ‘মুমতাজ বেগম’, ‘আমিনা’, ‘জওয়ানি কা নেশা’ এবং ‘নসীব কা চক্কর’–এর মতো ছবিতে গান গেয়েছেন এবং অভিনয় করেছেন। তবে, গৌহর জান এবং মালকা জানের মতো বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের গান শুনে তিনি চলচ্চিত্রের জগত ছেড়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৯৪৫ সালে লক্ষ্মৌর ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসীর সাথে তাঁর বিয়ে হয় এবং তিনি বেগম আখতার নামে পরিচিত হন। বিবাহের পর তাঁর স্বামী পাঁচ বছর গান গাওয়ার অনুমতি দেননি, যা তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
কেননা, বিয়েতে আব্বাসি সাহেবের শর্তই ছিল, আখতারিকে গান ছাড়তে হবে। কাজেই জীবনের মানেটা বদলে গেল আখতারির কাছে। সব আছে, অথচ কিছুই নেই! সংসার জীবনে একাধিকবার গর্ভবতী হয়েও জন্ম দিয়েছেন মৃত সন্তান। জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাই হারিয়ে ফেললেন আখতারি। চিকিৎসক এলেন। পরামর্শ দিলেন, এমন কিছু করার প্রয়োজন হল যাতে আখতারি ভাল থাকেন।‘শূন্য জীবনে’ নতুন করে আবার শুরু হল গান। গান গাওয়ার পাশাপাশি আখতারি এবার গান শেখাতেও শুরু করেন। আকাশবাণীর লক্ষ্মৌর স্টেশন ডিরেক্টর, আরেকজন বাঙালি সঙ্গীত–সমঝদার সুনীল বসু আব্বাসি সাহেবের বাড়ি গিয়ে অনেক কাকুতিমিনতি করে গান রেকর্ড করতে তাঁকে রাজি করান। আখতারি গান গাইবেন শুনে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে রেকর্ড করার প্রস্তাব দিল। তবে নাম আর আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি নয়! জন্ম হল এক নতুন শিল্পীর বেগম আখতার। সেই নামেই প্রকাশিত হল দু’টি বিখ্যাত গান। ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’ এবং ‘সঁইয়া ছোড় দে’। শুরু হলো বেগমের নতুন জীবন।
১৯৪৯ সালে তিনি লক্ষ্েণৗর রেডিও স্টেশনে তিনটি গজল ও একটি দাদরা গেয়ে সঙ্গীত জগতে ফিরে আসেন।
বেগম আখতার অল ইন্ডিয়া রেডিওর নিয়মিত শিল্পী ছিলেন এবং তিনি তাঁর নিজস্ব গজল ও গানের সুরারোপ করতেন, যা মূলত রাগভিত্তিক ছিল। ঠুমরি ও দাদরার গানে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল এবং তিনি পূরব ও পাঞ্জাবি ঘরানার মিশ্রণে নিজস্ব একটি গায়কী তৈরি করেছিলেন।
বেগম আখতারের কণ্ঠে বহু জনপ্রিয় গান রয়েছে। তাঁর কিছু বিখ্যাত গান হলো:
“অ্যায় মহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া”। “আহ কো চাহিয়ে এক উমর হোনে তক”। “মেরে হামনাফাস মেরে হামনাওয়া”। “কুছ তো দুনিয়া কি ইনায়েত নে দিল তোড় দিয়া”। “উলটি হো গয়ি সব তদবিরেঁ”। “পিয়া বলো অভিমান”। “জোছনা করেছে আড়ি”। “দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো”। “বালমওয়া তুম ক্যা জানো প্রীত” (দাদরা)
বেগম আখতার আকাদেমি পুরস্কার এবং ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী ও মরণোত্তর পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। তার গান আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছে।
১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে গুজরাটের আহমেদাবাদে একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাত্র ৬০ বছর বয়সে, সেখানেই প্রয়াত হন। দিনটি ছিল ৩০ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর পর লক্ষ্েণৗর ‘পসন্দাবাগ’–এ সমাধিটার ওপর দিনেদিনে জমেছে অজস্র ঝরা পাতা। আলগোছে কিছু পাতা মাটি ছুঁয়ে পড়ে আছে আজও।
জীবন, সে তো সুরের মতো ঘুরতে থাকে খাদের ধার ঘেঁষে। শত যন্ত্রণার ওপার থেকে আসা সঙ্গীতে ঈশ্বরের আহ্বান একমাত্র জ্বলতে থাকে মোমের আলো হয়ে।