ভালবাসার নগরী প্যারিস। আর সে প্যারিসের বুক চিরে চলে গেছে সিন নদী। যে নদীতে ভালবাসার নৌকা ভাসায় প্রেমিক–প্রেমিকারা। এবার সে সিন নদীতে ভাসল অলিম্পিকের নৌকা। বর্ণিল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠল ৩৩ তম অলিম্পিক গেমসের। দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন দ্যা আর্থ। বিশ্বের সবচাইতে বড় ক্রীড়া আসর। যাকে বিশ্ব ক্রীড়ার মহা মিলন বলা হয়ে থাকে। অলিম্পিকের আয়োজক হওয়াটা যেমন কঠিন তেমনি অলিম্পিক গেমস আয়োজন করাটা আরো বেশি কঠিন। তাইতো অন্তত চার বছর ধরে নানা পরিকল্পনা করতে হয় আয়োজক দেশকে । কিভাবে আয়োজনের দিক থেকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায়। আগের যতগুলো অলিম্পিক গেমস হয়েছে সবগুলোতে সবাই আগের আসরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে সবচাইতে বেশি তাক লাগিয়েছে এবারের আয়োজক প্যারিস। আগের সবগুলো অলিম্পিকের উদ্বোধন হয়েছে স্টেডিয়ামে। তবে এবারে ব্যাতিক্রম কিছু করে দেখাল প্যারিস। স্টেডিয়াম বাদ দিয়ে নদীতে উদ্বোধনের নৌকা ভাসাল প্যারিস। তবে পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জুড়েই ছিল বৃষ্টি। দর্শক, প্রতিযোগী, পারফর্মার সকলেই ভিজেছেন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গ্যালারিতে রেইনকোটও পরেছিলেন অনেকে।
সিন নদীর দুপাশের দালান গুলোকে সাজানো হয় বর্র্ণিলভাবে। তার মাঝখানে ছুটে চলছে অলিম্পিকের নৌকা। শুরুটা ফরাসি কিংবদন্তী ফুটবলার জিনেদিন জিদানকে দিয়ে। অলিম্পিকের মশাল হাতে জিদান ছুটছেন একটি ট্রেনে চড়ে। তাকে ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয় তিন কিশোর। ছুটে চলছেন জিদান। কিন্তু মাঝপথে জিদানের হাত থেকে মশালটি চলে যায় এক এলিয়নের হাতে। যাকে বলা হচ্ছে রহস্যময় মশাল বাহক। তার মুখ দেখা যায়নি। সে ছুটতে থাকে মশাল নিয়ে। পাহাড়–পর্বত, নদী নালা, দালান ডিঙিছে ছুটছে এলিয়েন। শেষ পর্যন্ত এই রহস্যময় মশাল বাহক ঢুকে পড়েন লুভর জাদুঘরে। এরই মাঝে সিন নদী ঘেষে নির্মান করা মঞ্চে আসেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কাউন্সিলের সভাপতি থমাস বাখ। তাদের সামনে চলতে থাকে অ্যাথলেটদের মার্চফাস্ট।
সিন নদীতে ভাসানো হয় বিশাল বিশাল নৌকা। নৌকা ঠিক না, দারুন সুন্দর সব ইয়ট। আর সে ইয়টে চড়ে মার্চফাস্ট করতে থাকে এবারের অলিম্পিকে অংশ নেওয়া দল গুলোর অ্যাথলেটরা। কোন ইয়টে একাধিক দল আবার কোন ইয়টে ছিল একটি দলের অ্যাথলেটরা। দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন ভাসমান খেলার মাঠ। বাংলাদেশ দলের কন্টিনজেন্টের পতাকা বহন করেন আর্চার সাগর ইসলাম।
সিন নদীর দুপাশে হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করে সে অনুষ্ঠান। নদীর দুপাশের দালানের ছাদেও হাজার হাজার নারী পুরুষ। তবে নদীতে এবং নদী তীরে ছিল নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। অনুষ্ঠানের শুরুতে অলিম্পিকের জন্মস্থান গ্রিসের কিছু ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। এরপর সিন নদীর দুপাশে দালান গুলো ঘেসে তৈরি করা মঞ্চে নাচ আগের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় ফরাসি ঐতিহ্য। বাদ যায়নি শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আকাঁ মোনলিসার ছবিও। একদিকে চলছিল সিন নদীতে অ্যাথলেটদের মার্চফাস্ট আর অন্য দিকে চলছিল ফরাসি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার নানা আয়োজন। অনুষ্ঠানে উন্মোচন করা হয় ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত দশ জন মহিলার মূর্তি। সঙ্গে দেওয়া হয় তাদের কৃতিত্বের বর্ননা। যাদের মধ্যে ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সমাজ সংষ্কারক। সিন নদীর দুপাশের দালান গুলো ঘেসে তৈরি করা হয় একাধিক মঞ্চ। যার সবকিছুতেই ছিল পানির ছোঁয়া। নদীতে ভাসমান মঞ্চ তৈরি করে চলে নানা অনুষ্ঠানে। অলিম্পিক গেমসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মাসকট। এবারের প্যারিস অলিম্পিকের মাসকটের নাম ‘দ্যা অলিম্পিক ফ্রাইরেজ’। যা আকৃতি দেওয়া হয়েছে ছোট্ট ট্র্যাডিশনাল ফ্রাইরেজ টুপি বা হ্যাটের মত। স্বাধীনতা, ঐক্য, সামাজিক ও মানবিক কাজে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রতীক এই ফ্রাইরেজ হ্যাট। ফরাসি বিপ্লবের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে এই ফ্রাইরেজ হ্যাট। রোমান সভ্যতার সময়ে যারা দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ ছিল তাদের স্বাধীনতাকে তুলে ধরে এই টুপি। মাসকট নিয়ে গেমসের ইভেন্ট গুলো তুলে ধরা হয়। অনুষ্টানে সংগীত পরিবেশন করেন ফরাসি ভাষা জানা শিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় নাকামুরা। তার সাথে বাজিয়েছেন রিপাবলিকান গার্ডের বাদ্রযন্ত্রী এবং ফলাসি সেনার শিল্পিরা। অ্যাথলেটদের নৌকা করে প্যারেডের মাঝে গান গাইলেন লেডি গাগা। তার আগে ফ্রান্সের অন্যতম সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনী স্থ গ্রাঁ প্যালাই থেকে ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন আলেঙ সাঁ সিরেল।
অনুষ্টানে দেখানো হয় কিভাবে এবারের অলিম্পিকের মেডেলগুলো তৈরি করা হয়েছে। তবে নৌকায় মার্চফাস্ট অ্যাথলেটরা দারুন উপভোগ করেছেন। কারণ এটি তাদের কাছেও নতুন একটি ধারণা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ্রইমানুয়েল ম্যাক্রন এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান থমাস বাখ আনুষ্ঠানিকভাবে ৩৩ তম অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন ঘোষনা করেন। বিশ্বের প্রায় ২১০ টি দেশের দশ হাজারের বেশি অ্যাথলেট এবারের অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছেন। ফ্রান্সের সময় বিকেলে শুরু হওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যতই সূর্যাস্তের দিকে গড়াচ্ছিল ততই যেন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসছিল । এমনিতেই বিশ্বের তাবত প্রেমিক যুগলের কাছে সিন নদীতে ভেসে ভেসে সূর্যাস্ত দেখতে পারার আনন্দটাই অন্যরকম। এবারের অলিম্পিকের উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি শেষ হয়েছে ঠিক সূর্যাস্তের সময়। এ যেন এক অপূর্ব দৃশ্য। শেষে আতশবাজির ঝলকানিতে শেষ হয় এবারের প্যারিস অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। অনুষ্ঠান শেষ হলেও রেখে গেল এক দারুন আনন্দ। যা অলিম্পিকের ইতিহাসে দারুন এক সংযোজন। যে অনুষ্ঠান ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে।