খাগড়াছড়িতে নির্বিচারে বন কাটা হচ্ছে। বনখেকোদের দৌরাত্ম্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘খাগড়াছড়িতে বনখেকোদের দৌরাত্ম্য, প্রতিদিন উজাড় হচ্ছে ১৬ হাজার ৫শ মণ গাছ দুর্গম এলাকা হওয়ায় নজরদারি কম’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, সামপ্রতিককালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বন বিভাগের নজরদারি বাড়লেও অরক্ষিত অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলে নজর কম। এসব বনাঞ্চল নিয়ে এখনো কোনো জরিপ হয়নি। সাধারণত খাস পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে যে বন গড়ে ওঠে তা অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের আওতাভুক্ত। এসব বন থেকে নির্বিচারে গাছ কেটে নিচ্ছে বনখেকোরা।
পার্বত্য এলাকায় গাছ কাটতে হলে সরকারি অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু নজরদারি ও তদারকির অভাবে বিনা অনুমতিতে বন থেকে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনখেকোরা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বনাঞ্চল উজাড়ের তথ্য। প্রতিদিন খাগড়াছড়িতে বিভিন্ন অশ্রেণিভুক্ত বন থেকে উজাড় হচ্ছে ১৬ হাজার ৫শ মণ গাছ। ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, এভাবে বন ধ্বংসের পেছনে ইটভাটা মালিকদের ইন্ধন রয়েছে। এক শ্রেণির দালাল চক্রের মাধ্যমে তারা বন উজাড় করছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী সীমানাপাড়া এলাকা। পাড়া থেকে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর বনখেকোদের দেখা মিলল। বনের গাছ পরিবহন করার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছে। আসন্ন বর্ষায় পাহাড়ের রাস্তা ধসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিয়ন্ত্রণহীন থাকায় অবাধে বৃক্ষ নিধন চলছে পাহাড়ে। বিশেষ করে মাতৃবৃক্ষ ধ্বংস করায় পাহাড়ি বনের টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বৃক্ষ নিধন থেকে বাদ যাচ্ছে না রিজার্ভ ফরেস্টও। ধারাবাহিকভাবে মাতৃবৃক্ষ নিধন হতে থাকলে একসময় বনের অস্তিত্ব ও বন্যপ্রাণির আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়বে।
একসময় পাহাড়ের বনে দেড়-দুইশ বছর বয়সী চম্পাফুল গাছ, আদি গর্জন, জারুল, জাম আর সেগুন গাছের দেখা মিলত। কিন্তু বনায়ন ধ্বংস, নতুন করে বনসৃজন বন্ধ, অবাধে গাছ কাটার পরিণতিতে শতবর্ষী এসব বৃক্ষ আজ বিলুপ্তির পথে। পাহাড়ে বিভিন্ন বনাঞ্চল, বিশেষ করে রিজার্ভ ফরেস্টে দেড়-দুইশ বছর বয়সী মাতৃবৃক্ষ ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি অঞ্চলে কাচালং রিজার্ভ রেঞ্জের অধীনে প্রায় ৪ লাখ একর বন রয়েছে। এই অঞ্চলের কাচালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাচালং-সাজেক অংশ থেকে প্রায় ২শ বছর বয়সী চম্পা ফুল গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয়রা। সাজেকে পর্যটন এলাকা গড়ে ওঠায় নতুন রিসোর্ট নির্মাণের কারণেই অবাধে চলছে চম্পা ফুল গাছসহ শতবর্ষী চাপালিশ, জাম, গর্জন, আদি জারুল, সেগুনসহ মূল্যবান কাঠের গাছ।
পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের মতে, অনুমতি ছাড়া অশ্রেণিভুক্ত বনের গাছ কাটার নিয়ম নেই। কিন্তু খাগড়াছড়িতে নির্বিচারে বন কর্তন হয়। এভাবে চলতে থাকলে একসময় সবুজ পাহাড় বলতে কিছু থাকবে না।
আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বনের গাছ কাটা বন্ধে টাস্কফোর্স করে অভিযান জোরদার করার দাবি জানান খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সরোয়ার জামান। তিনি বলেছেন, অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল মূলত জেলা প্রশাসকের আওতাধীন। বিনা অনুমতিতে এসব বন থেকে গাছ কাটার সুযোগ নেই। তবে অবৈধভাবে কেউ বনজ দ্রব্য পরিবহন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার বন বিভাগের রয়েছে। বনবিভাগ অভিযান জোরদার করবে। অনুমতি ছাড়াই কয়েক বছর ধরে বন-পাহাড় উজাড় করে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে দেখেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তাই বৃক্ষনিধনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
অবাধে বন উজাড়, পাহাড় কেটে আবাসন কোম্পানির সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণসহ প্রভাবশালী দুষ্কৃতকারীদের নানা বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে প্রতিবছর পাহাড় ধসে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। অথচ পরিবেশগত এই বিপর্যয় ও পাহাড় ধসে বিপুল প্রাণহানি রোধে সরকারের ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেই। অবিলম্বে পাহাড় ধসের মূল কারণ বন উজাড় ও পাহাড় কাটা বন্ধ করা হোক এবং এর সঙ্গে সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক।