বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও বৈচিত্র্যময় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। তার সর্বশেষ সংস্করণ হলো জেনেটিক গেইন।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো ফসলের বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন ঘটানো, সেই সাথে নির্দিষ্ট শতাংশ বেশি উৎপাদন হওয়াকে জেনেটিক গেইন বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধানের এমন সব জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে, যেগুলো অল্প সময়ে বেশি বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম। একই সাথে ধানের মানেরও উন্নয়ন ঘটবে। এখানে মান বলতে মূলত ধানের সুগন্ধ, চকচকে, দেখতে চিকন ও আকর্ষণীয় হবে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে এই আধুনিক জাতের ধান দিয়ে ফলন শুরু হয়েছে, সেই সাথে গবেষণাও অব্যাহত রয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত ১১৩টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৮টি হাইব্রিড জাতের। প্রতিটি জাতই কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তবে বর্তমানে প্রচলিত বেশিরভাগ জনপ্রিয় ধানের জাতের বয়স ২৮–৩০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। এগুলোকে অনেক সময় ‘বুড়ো’ ধানও বলা হয়। এসব ধানের ফলন সময়ের সাথে সাথে কমে আসতে শুরু করেছে। এই সময়ের মধ্যে আরও অনেক নতুন জাত উদ্ভাবন হলেও সেগুলো আগের জনপ্রিয় জাতগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল বাংলাদেশ। তবে জেনেটিক গেইন সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে বলে আশা করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর সমাধান : ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জানান, প্রচলিত ধানের জাত যদি প্রতি হেক্টরে দেড় টন উৎপাদন হয়, সেখানে জেনেটিক গেইন প্রযুক্তির কারণে হেক্টর প্রতি দুই মণ ধান উৎপাদন সক্ষম। ফলে জেনেটিক গেইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানো এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন ২৫% বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, জেনেটিক গেইন বৃদ্ধি, অনাবাদী জমি চাষ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে প্রধান এই খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে।
লক্ষ্য থাকবে মান উন্নয়নেও : সরকারের মূল লক্ষ্য ধানের উৎপাদন বাড়ানো হলেও আরেকটি লক্ষ্য কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ। এক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল ধানের পাশাপাশি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি বা উচ্চমানের ধান উৎপাদনেও জোর দেয়া হচ্ছে। যে ধানের বাজারদর বেশি সেটিই উচ্চমানের ধান। এটি সুগন্ধযুক্ত, চিকন ও চকচকে হতে পারে।
ধান বুড়ো হচ্ছে কেন : প্রচলিত ধানগুলোর ফলন কমে যাওয়ার পেছনে ধানের চারা কখন রোপণ করা হচ্ছে, ভূ–প্রকৃতি, আবহাওয়া কেমন, ধানের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা এমন আরও নানা বিষয় নির্ভর করে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের খন্দকার মো. ইফতেখারুদ্দৌলা জানান, ধান একটি স্বপরাগায়িত ফসল। এর ফলে উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তবে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের রোগবালাইয়ের ধরন, পোকামাকড়ের বায়োটাইপ প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এমন আরও নানা কারণে বর্তমানে প্রচলিত জাতগুলোর উৎপাদন আগের চেয়ে কমে গেছে। এ কারণে ধানের প্রচলিত এই জাতগুলোকে অনেকেই ধানের বুড়ো হয়ে যাওয়া বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
আগামী দিনের ধানের জাতে জেনেটিক গেইন বা জিনগত ফলন অনেক বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ কারণে ধানের উৎপাদনশীলতা যেমন বাড়বে, তেমনি ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের সময়কাল চার থেকে পাঁচ বছর কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ফলে আগে যেখানে ধানের একটি জাত উদ্ভাবনে ১০–১৫ বছর লেগে যেত এখন তা ৮–১০ বছরে সম্পন্ন করা যাবে।
বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধান উৎপাদন বা জেনেটিক গেইন বাড়ানোর জন্য ধানের প্রজনন চক্রের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করা, প্রজনন লাইন নির্বাচন নির্ভুল করা, প্রজনন তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক কৌশল ব্যবহার এবং ব্যাপকভাবে সরেজমিন মাঠ গবেষণা করে নানা ধরনের জাত উদ্ভাবন করছে। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়।