বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য : বৌদ্ধধর্মের বিশ্বজনীনতা

ড. সবুজ বড়ুয়া শুভ | রবিবার , ১১ মে, ২০২৫ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

একটা সমপ্রদায়ের আত্ম পরিচয়ের বাহন একদিকে তার দর্শন ও ধর্ম, তেমনি অন্যদিকে তার ঐতিহ্য ও চলমান বর্তমান। বাংলাদেশী বৌদ্ধদের রয়েছে তেমনি গৌরবোজ্জ্বল ধর্ম, দর্শন ও ঐতিহ্য। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বর্ণবাদ, গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্ম এক ব্যাপক বিদ্রোহ। ঘন ঘোর তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ, হিংসাবিদ্বেষ হত্যাজিঘাংসা, হানাহানি, স্বার্থপরতা, বর্ণাশ্রম জাতিভেদ প্রথার উৎপীড়নে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, মহাকালের সেই ক্রান্তি লগনে ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে উদিত হয়েছিল এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ।

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা! বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে তৎকালীন ভারতবর্ষে বর্তমান নেপালের কপিলবাস্তু রাজা শুদ্ধোধন ও রানি মহামায়ার কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় এক রাজশিশু। নাম তাঁর সিদ্ধার্থ। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণপ্রাপ্তি এই তিনটি অনন্য ঘটনা শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ঘটেছিল বলেই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা।

উল্লেখ্য যে, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পর থেকে বুদ্ধবর্ষ গণনা শুরু হয়। গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন আজ থেকে দুই হাজার ৫৬৯ বছর আগে। আজ থেকে নতুন বুদ্ধবর্ষ ২৫৬৯ বর্ষ শুরু হলো। গৌতম বুদ্ধ ৮০ বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। সেই হিসাবে তিনি আজ থেকে ২৬৪৯ বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

মূলতঃ যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৬২৩ বছর আগে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। ৩৫ বছরে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৫৮৮ বছর আগে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। অর্থাৎ তিনি যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৪৪৩ বছর আগে মহাপরিনির্বাণ (মৃত্যু) লাভ করেন। ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সর্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে। সম্রাট অশোক, সম্রাট কণিষ্ক, রাজা অজাতশত্রু, হর্ষবর্ধন এবং পালবংশীয় রাজদের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধদের সামাজিক অবস্থা শৌর্য বীর্যহীন হয়ে পড়ে। এতদ্‌ সত্ত্বেও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে সমতল এলাকায় (বৃহত্তর চট্টগ্রাম কুমিল্লা ও নোয়াখালী) বৌদ্ধ ধর্মের সেই প্রদীপ্ত শিখা অম্লান থেকেছে।

সেই সময় বৌদ্ধ মনীষীদের দেশ ত্যাগের ফলে এদেশে রচিত গ্রন্থের অস্তিত্ব নেপাল, তিব্বত ও চীন দেশে পাওয়া যায়। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপাল রাজ দরবার থেকে আবিষ্কৃত এদেশের সিদ্ধাচার্যদের রচিত বাংলাভাষার আদি নিদর্শন বৌদ্ধ গান ও দোঁহা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পাহাড়পুর সোমপুরী মহাবিহার, বাসু বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় কুমিল্লার ময়নামতি শালবন বিহার, দিনাজপুরের জগদ্দল বিহার, আনন্দ বিহার, চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার, নালন্দা তক্ষশিলা, অজন্তা, ইলোরা, গান্ধারা, প্রভৃতি আমাদের অতীত ইতিহসের উজ্জ্বলতায় চিরভাস্বর।

বৌদ্ধ ধর্মের যে স্বকীয় শক্তি রয়েছে তা বিশ্বধর্মে রূপান্তরিত হয়ে সারা বিশ্বে পরিব্যপ্ত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ আজও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধ ধর্ম যেহেতু কার্যকারণ নীতিতে বিশ্বাসী, কর্মবাদে প্রতিষ্ঠিত, আত্মশক্তিতে বলীয়ান বা আপন শক্তির উপর নির্ভরশীল, অদৃশ্য কোনো শক্তির উপর নির্ভরশীল বা বিশ্বাসী নয়, সেই জন্য বৌদ্ধ ধর্ম একবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং উৎকর্ষতার মাঝেও তার অস্থিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম। বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার স্থান নেই। মানুষই তার নিজের স্রষ্টা, তার আপন কর্মই তাঁর সৃষ্টিকর্তা। তাই বৌদ্ধধর্ম তার কর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সৎকর্মের জন্য সুফল, কুকর্মের জন্য কুফল, এখানে অপরাধ জনক কর্মের ক্ষমা করবার কেউ নেই। কর্ম মানুষের জীবনের সাথে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। ধর্মে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অনুপস্থিতিকে অনেকে বৌদ্ধদেরকে শূন্যবাদ বা উচ্ছেদবাদ বলেন, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে যুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ধর্মে জাতিভেদ প্রথা, অলৌকিকত্ব, অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে চরমভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।

বৌদ্ধধর্মে চারি ব্রহ্মবিহারের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ব্রহ্মাবিহার হলো চারটি বৌদ্ধ গুণের ক্রমধারা এবং ধ্যান অনুশীলন। এগুলি চারটি অপরিমেয় বা চার অসীম মন নামেও পরিচিত। চারি ব্রহ্মাবিহার হলোমৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা।

মৈত্রী, পালিতে যা হলো মেত্তা। মানে দানশীলতা, প্রেমময়দয়া, বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, ভালো ইচ্ছা, এবং অন্যদের প্রতি সক্রিয় আগ্রহ। এটি চারটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাজ্যের (ব্রহ্মবিহার) মধ্যে প্রথম এবং বৌদ্ধধর্মের থেরবাদ দর্শনের দশটি পারমিতার একটি। মৈত্রী, আমরা যেমনটা নিজের সুখ প্রার্থনা করি, ঠিক তেমনি জগতের সকল প্রাণীর সুখ প্রার্থনা করাই হচ্ছে মৈত্রী।

করুণা, আমরা নিজের দুঃখ কষ্ট যেভাবে অনুভব করি, ঠিক সে ভাবেই অন্য প্রাণীদের দুঃখ কষ্ট অনুভব করার নামই করুণা। মুদিতা, আমরা যেমন নিজেদের লাভ, যশ, খ্যাতি, প্রাচুর্য দেখে আনন্দিত হই, ঠিক তেমনি অন্যদের লাভ, যশ, খ্যাতি, প্রাচুর্য দেখে আনন্দিত হওয়ার নামই হচ্ছে মুদিতা। উপেক্ষা, লাভঅলাভ, যশঅযশ, নিন্দাপ্রশংসা, সুখদুঃখ, ইত্যাদি অষ্ট লোকধর্মে মনে স্থির ভাব নিয়ে থাকাই হচ্ছে উপেক্ষা।

থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের মধ্যে প্রেমপূর্ণ দয়া বা মৈত্রী, সহানুভূতিপূর্ণ আনন্দ হচ্ছে মুদিতা এবং মনের স্থিরতা হলো উপেক্ষা এর সাথে করুণা, চারটি ‘ঐশ্বরিক আলয়’ (ব্রহ্মবিহার)এর একটি। ত্রিপিটকে বুদ্ধ, গৃহী এবং সন্ন্যাসী উভয়দের এইসব চার পবিত্র মানসিক অবস্থার অনুশীলন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। এই ধরনের অভ্যাস একজনের মনকে শুদ্ধ করে, মন্দপ্রণোদিত পরিণতি এড়িয়ে চলে, তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন সুখের দিকে পরিচালিত করে।

বৌদ্ধ ধর্ম এমন এক জীবন চর্যা, যার মর্মমূলে রয়েছে বিদর্শন ভাবনা (Meditation) বৌদ্ধ ধর্মের মূলভিত্তি এই বিদর্শন ভাবনা। যা নিজেকে নিজে দর্শন করবার, জানবার সুযোগ এনে দেয়। বুদ্ধের দেশিত পঞ্চশীল নীতি গভীরভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে মানব জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা সক্ষম। জীবনকে সুশৃঙ্খল, সুন্দর করে গড়ার জন্য অষ্ট অঙ্গ সমন্বিত একটি পথ বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণের গুরুত্ব সমধিক, যার মাধ্যমে চরম সত্য নির্বাণ দর্শন সম্ভব। এখানে ঐশ্বরিক বা অন্যকোন শক্তির উপর নির্ভর করার অবকাশ কিংবা প্রয়োজন নেই। তাই তাঁর সাহসী উচ্চারণ, ‘তুমি তোমার নিজের কর্তা, নিজের স্রষ্টা, তুমিই তোমার পরিত্রাতা’।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে মানুষের জীবনে অন্যান্য ধর্মের তুলনায় বৌদ্ধ ধর্ম কতোটুকু আবেদন রাখতে পারছে, তা উপরোক্ত আলোচনায় অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। বৌদ্ধধর্মের উদার মানবতাবাদ, সৌহার্দসমপ্রীতিসৌভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে মৈত্রীর মেলবন্ধন রচনার পুণ্যময় দিন হোক শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। সকল কলুষকালিমা দূর হয়ে যাক, সবার হৃদয় আলোয় আলোয় ভরে উঠুক, আজকের শুভ দিনে এই হোক একমাত্র প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ