বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি : পর্যালোচনা ও প্রস্তাব

সুমন হায়াত | শনিবার , ১৩ মার্চ, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের একটি আলোচিত বিষয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এই বহুলালোচিত বিষয়টি নিয়ে উদাসীন এ কথা বলা যায় না। বরং কিছুদিন আগে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা উপহার দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। নিঃসন্দেহে এই প্রচেষ্টাটি একটি সাধুবাদযোগ্য উদ্যোগ। কিন্তু মঞ্জুরী কমিশন যে প্রত্যাশা নিয়ে এ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আশাবাদী হয়েছিল তা প্রণিত নীতিমালার বিশেষ কিছু দুর্বলতার কারণে সর্বক্ষেত্রে অভিনন্দিত হয় নি এবং সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে তা সানন্দে গ্রহণ ও অনুসরণ করে নি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ নীতিমালার আলোকে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তা গ্রহণ করেছে আংশিক হিসেবে। অর্থাৎ নিজেদের কায়দামাফিক কিছু অংশ গ্রহণ ও কিছু অংশ বর্জন করে। ফলত এর অর্থ দাঁড়ায় অভিন্ন নীতিমালাটি আর অভিন্নভাবে গৃহীত হয় নি। বিশেষ করে ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ দ্বারা গঠিত দেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ নীতিমালাকে গ্রহণ না করে এর অসংগতি ও অন্যায্য প্রস্তাবসমূহের আশু সংস্কার নিশ্চিত করার পরামর্শ প্রদান করে। প্রতিনিধিত্বশীল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাদেশ তথা গঠন আইনে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া আছে। ফলে তাদের বিবেচনায় মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরী কমিশনের যুক্তিসংগত নয় এমন যে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ না করার আইনসংগত অধিকার তাদের আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কিছু আরোপ করা স্বায়ত্তশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ। পক্ষান্তরে প্রতিষ্ঠানগুলো এই ধরনের কোনো কিছুকে মেনে নেওয়াও মনে করে স্বায়ত্তশাসনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে। তবু মঞ্জুরী কমিশনের যুক্তিসংগত কোনো আদেশ বা প্রস্তাব তাঁরা মেনে নেবে না এমন কোনো নেতিবাচক কথা কখনো তাদের তরফ থেকে আসেনি। যদিও স্বায়ত্তশাসনের সুযোগকে অপপ্রয়োগ করে শিক্ষক নিয়োগসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কম নিন্দাসঞ্চয় করে নি। অভিন্ন নীতিমালার সবচেয়ে বড় গলদ হিসেবে যা চিহ্নিত করা হয় তা হলো সকল অনুষদের জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটিতে ন্যূনতম সিজিপিএ/জিপিএ ৩.২৫ ও অন্যটিতে ৩.৫০ থাকার শর্ত। একটি কথা বোদ্ধাজনের স্মরণ রাখতে হবে সকলের জন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করতে গেলে সংখ্যায় গরিষ্ঠজন যেন আবেদন করতে পারে এ দিকটিকে বিবেচনা করতে হবে। একটি উচ্চ স্কোর নির্ধারণ করে দেওয়া আবেদনের অধিকার থেকেই বঞ্চিত করার নামান্তর। নাগরিককে আবেদনের সুযোগ দেওয়ার অর্থ তো তাকে চাকরি দেওয়া নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চতর স্কোর অর্জনকারীর বিষয়টি বিস্মৃত হবার কথা নয়। তাদের বিবেচনায় নিশ্চয় সে প্রার্থী যতটুকু অগ্রাধিকার পাবার কথা তা পাবেন। অন্যদিকে বলা হয় সিজিপিএ ৩.৫০ থাকতে হবে অথবা সনাতন পদ্ধতিতে ১ম শ্রেণি/বিভাগ থাকতে হবে। অথচ এই কথাটি সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ০২জুন ২০০৯ তারিখের জারিকৃত নং শিম/শা:১১/৫-১(অংশ)/৫৮২ সংখ্যক প্রজ্ঞাপনে প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির সঙ্গে পূর্বের বিভাগ/শ্রেণির সমতাকরণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৪ স্কেলে কোনো শিক্ষার্থী ৩.০০ অর্জন করে থাকলে তাঁর অর্জিত শ্রেণি/বিভাগ হবে ১ম শ্রেণি। অর্থাৎ ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.০০ নির্ধারণ করার অর্থ হচ্ছে সর্বনিম্ন ১ম শ্রেণি চাওয়া। ১ম শ্রেণি চাওয়ার সহজ অর্থ তো সিজিপিএ ৩.০০ হওয়াই বিজ্ঞানসম্মত। সিজিপিএ ৩.৫০ নির্ধারণ করাতো অত্যাধিক হয়ে যায়। তাই ন্যূনতম সিজিপিএ/জিপিএ ৩.০০ নির্ধারণই যুক্তিযুক্ত। একই প্রজ্ঞাপনে এসএসসি ও এইচএসসি’র সমতা নির্ধারণে ৩.৫০ ও ৪.০০ এর তদুর্ধ্ব গ্রেডকে প্রথম বিভাগ করা হলেও এর সংশোধনি এনে শিক্ষামন্ত্রণালয় ০২ মার্চ ২০১০ তারিখে আরো একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যার নং শিম/শা:/১১/১৯-১/২০০৭/১৭৪। সংশোধিত এই প্রজ্ঞাপনে জিপিএ ৩.০০ বা তদুর্ধ্বকে প্রথম বিভাগ ধরা হয়েছে। তাই ন্যূনতম গ্রেড ৩.০০ নির্ধারণই এর যুক্তিযুক্ত সমাধান। তাছাড়া ৪ স্কেলে বিভিন্ন অনুষদভুক্ত অনেক বিভাগ রয়েছে যেখানে ৩.৫০ অর্জনই ঐ বিভাগের অর্জিত সর্বোচ্চ রেকর্ড সিজিপিএ। বাংলা-ইংরেজির মতো সাহিত্য বিভাগে ৩.০০ স্কোর অর্জন করাই অপেক্ষাকৃত কঠিনকর্ম। তাই এই ধরনের বিভাগের জন্য ৩.৫০ নির্ধারণ একটি জবরবস্তিসম সিদ্ধান্ত। মঞ্জুরী কমিশনের অভিন্ন নীতিমালায় যেটি বিস্ময়কর বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে এমফিল ও পিএইচডির মতো গবেষণালব্ধ ডিগ্রিকে মূল্যায়ন বিবেচনায় না আনা। অথচ সদ্য এমএ পাস করা শিক্ষর্থী যিনি আজকে এমএ উত্তীর্ণ হলেন কালকেই শিক্ষক হয়ে গেলেন এবং এমএ ক্লাসেই পড়াতে গেলেন। যে কোনো বিবেচনাতেই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী ব্যক্তি তাঁর চেয়ে অধিকতর যোগ্য বিবেচিত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের ন্যায্য প্রাপ্তি হিসেবে কি তাঁর প্রাপ্য নীতিমালায় তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে যা স্পষ্টতর হবার দাবি অনিবার্য। এইরকম পরিস্থিতিতে বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিনিধি ও মঞ্জুরী কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় ও পরামর্শ গ্রহণপূর্বক একটি আদর্শ নীতিমালা চূড়ান্তকরণের কাজ এগিয়ে এনেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। চূড়ান্ত না হলেও প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে শিক্ষক নিয়োগে বিবেচনায় না আনা। নিঃসন্দেহে এটি যুক্তিসংগত। এটি ভাল ফল অর্জনকারীদের প্রতি অবহেলা নয়, বরং যে বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে তিনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বিষয়েই পাঠদান করবেন। তাই সে বিষয়ের ফলাফলই বিবেচনায় প্রাধান্য পাবে এটি যুক্তিসংগত চিন্তা। অন্যদিকে সকল বিভাগের জন্য ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০ ধরা হলে এটি খানিকটা অস্বাভাবিক ঠেকে। কারণ সকল বিভাগের জন্য হলে ৩.০০ নির্ধারণই যথেষ্ট। কেননা ন্যূনতম ৩.০০ মানে প্রথম বিভাগ। ন্যূনতম যদি ১ম বিভাগ হয় তাহলে এর বেশি চাওয়া এটি বেশি চাওয়াই হয়। কারণ এটি নির্ধারিত হচ্ছে আবেদনের যোগ্যতা, চাকরি পাবার একমাত্র যোগ্যতা নয়। কোনো তৃতীয় বিভাগ বা সমমানের গ্রেড কোনো প্রার্থীর না থাকলে তাঁর যদি পিএইচডি ডিগ্রি থাকে তাহলে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না করে সরাসরি আবেদনের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয় বিবেচনা করা যায়। এই নিয়মটি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বিদ্যমান রয়েছে যা অবশ্যই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হওয়া জরুরি। কেননা পিএইচডি বিশ্বস্বীকৃত সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রি। এর গুরুত্ব ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা বিশ্ববিদ্যালয়েরই দায়িত্ব। শিক্ষামন্ত্রণালয় যে আশার বাণী সামনে নিয়ে এসেছেন আমরা বিশ্বাস করি এবার এর একটি অর্থবহ সমাধান সত্যিই বেরিয়ে আসবে। অস্বীকার করা যায় না ভাল শিক্ষার্থী মাত্রই ভাল সিজিপিএ অর্জন করতে সক্ষম হন। কিন্তু এও স্বীকার করতে হবে সিজিপিএ ভাল অর্জিত হলেই তিনি ভাল শিক্ষক হবেন এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তাই মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকের পাঠদান দক্ষতা ও পারঙ্গমতা যাচাই করতে ডেমোনেস্ট্রেশন ক্লাসের মাধ্যমে মেধা মূল্যায়নের প্রস্তাব করি আমরা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅশান্ত হৃদয়ের নীরব কান্না
পরবর্তী নিবন্ধবামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা : দেশে ও বিদেশে