বিশ্ববাসী এখন বন্ধুত্ব লাভের প্রতিযোগিতা দেখছে

এম.এ. মাসুদ | মঙ্গলবার , ১২ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন, বাস্তুচ্যুতি আর তাদের রক্ত ঝরিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের তৎকালীন সর্দার যুক্তরাজ্য প্যালেস্টাইনের বিরাট একটি অংশ দখল করে নিয়ে সেই ভুখণ্ডে ইসরাইল নামের একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে এবং রাশিয়া সহ অন্যান্য দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদীদের ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া এই ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল নামক এই দেশে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে নতুন বসতি স্থাপন করা ইহুদিদের সর্বপ্রকার সামরিক ও অর্থনৈতিক মদদ দানে এগিয়ে আসে। নতুন ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত এ সকল দেশ কর্তৃক ইসরাইলকে সকল প্রকার সাহায্য অব্যাহত রয়েছে। পক্ষান্তরে দুর্ভাগা ফিলিস্তিনিদের উপর পশ্চিমা বিশ্বের মদদপুষ্ট ইসরাইল অত্যাচার, নিপীড়ন এবং নির্বিচারে হত্যা অব্যাহত রেখে ফিলিস্তিনিদের পূর্ব পুরুষের ভিটা মাটি থেকে উচ্ছেদ করে উচ্ছেদকৃত স্থানে ইসরাইল নতুন নতুন বসতি স্থাপন করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনিদের পশ্চিম তীর ও গাজা নামক দুটি ক্ষুদ্র ভুখণ্ডে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ফিলিস্তিনিদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ সহ তাদের জীবিকা নির্বাহের সকল বিষয় ইসরাইলের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভরশীল। ফিলিস্তিনিরা আজ নিজ দেশে পরবাসী।
ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী আরব দেশগুলো তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ। এসব দেশের কর্ণধারগণ, প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং অর্থ সম্পদে ধনী ব্যক্তিবর্গ বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। বিদেশে এদের প্রমোদ সফর এবং বিলাস ব্যসনের খবর সবারই জানা। গরীব বিশ্বের দরিদ্র মানুষ যেখানে জীবন ধারণের জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ঘাম ঝরাচ্ছে তখন ধনাঢ্য আরব দেশের এসব ধনী ব্যক্তিবর্গ সম্পদের অপচয়-অবচয়ে লিপ্ত। বিশ্বের চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে এসব দেশ নির্লিপ্ত। নিজ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এরা ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। নিজেদের দেশকে রক্ষার জন্য এদের কোনো নিজস্ব উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা নেই। প্রচেষ্টা নেই নিজস্ব শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ার। বর্তমানে এসব দেশের যে সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে তারা প্রশিক্ষণে অত্যন্ত দুর্বল এবং আধুনিক সমরাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। সব আরব দেশ একযোগে কয়েকবার ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে লজ্জাজনকভাবে হেরেছে। এসব যুদ্ধের সময়, যাদের তারা ত্রাণকর্তা হিসেবে ভাবে, সেই যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র সহ সব পশ্চিমা দেশ ইসরাইলের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। তাদের বন্ধু এসব দেশ তাদের রক্ষা করেনি। নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর কোনো প্রচেষ্টাই এসব আরব দেশের নেই। পাখী কখনো ডাল ভেঙে পড়ে যাওয়ার ভয় করে না। কারণ তার বিশ্বাস ডালের উপর নয়, তার বিশ্বাস এবং নির্ভরতা নিজ ডানার উপরে। তাই নিজের উপর আস্থাবান হওয়া প্রয়োজন, অন্য কারো উপরে নয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর নিজেদের প্রতিরক্ষায় আত্মবিশ্বাসের প্রবল ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে তারা ভীষণ নির্লিপ্ত আর উদাসীন। বিলাসী জীবন যাপন এবং পরনির্ভরশীলতার কারণে এসব দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে রেখেছে। ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলীদের বর্বর অত্যাচারের বিষয়ে এসব আরব দেশ আজ ক্ষীণ কণ্ঠেও প্রতিবাদ করে না। কারণ এতে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হতে পারে। হাজারো রকম ফুলের মধ্য হতে ফুল বিশেষজ্ঞ কোনটি কোন ফুল তা চিনতে পারে, পাখি বিশেষজ্ঞ দেশী-বিদেশী পাখি দেখলে তার মধ্য হতে কোনটি কোন পাখি তা চিনে নিতে পরে। কিন্তু মানুষকে চেনা যায় না। মানুষ মুখে আর অন্তরে এক নয়। ঠিক তেমনি আরব দেশ সমূহের বন্ধুদের, যারা তাদের প্রতিরক্ষায় সাহায্য করার কথা, তাদের চেনা যায় না। তাদের মনের খবর আঁচ করা যায় না। একটি মাত্র ছোট দেশ ইসরাইলের সামরিক সক্ষমতার কাছে এসব আরব দেশের সামরিক শক্তি হাস্যস্পদ। অস্ত্র দিয়ে, প্রযুক্তি দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে এখন সামরিক শক্তিতে এতই বলিয়ান করে তুলেছে যে, সে তুলনায় এই দুটি দেশ আরব দেশসমূহের প্রতিরক্ষায় অস্ত্র বিক্রি ছাড়া আর কিছুই করেনি এবং এই বিক্রিত অস্ত্র নির্ভুলভাবে চালানোর যথাযথ প্রশিক্ষণও দেয়নি।
সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হল, বর্তমান সময়ে বেশ কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের বন্ধুত্ব লাভের প্রত্যাশায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। যে সব দেশ এখনো কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি তারাও শীঘ্রই সে পথেই হাঁটবে। ইতিমধ্যে ইসরাইলের সাথে গোপনে কয়েকটি আরব দেশের মধ্যকার পারস্পরিক সফর এবং কথা-বার্তা বিনিময়, খানাপিনা হয়েছে। গত ২৮ মার্চ ২০২২ ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমির একটি স্থানে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং কয়েকটি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে। ইসরাইল এখন এসব আরব দেশের বন্ধু। হাজার হাজার ফিলিস্তিনবাসীর বাস্তুচ্যুতি, তাদের উপর ইসরাইলী অত্যাচার নিপীড়ন আর গণহত্যার কথা ভুলে গিয়ে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করে আরব দেশ সমূহের ইসরাইলের সাথে সখ্যতা স্থাপন বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখছে আর ফিলিস্তিনিদের অন্তর মথিত দীর্ঘশ্বাস আর মর্মবেদনা, দুঃখ-যাতনা বিশ্বের মানুষকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। জীবনে খারাপ সময় এলে মুখোশ পরা বেঈমান এবং বন্ধু চেনা যায়। আরবদের জীবনে খারাপ সময় বেশ কয়েকবার এসেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, এই আরবরা এর থেকে কোনো শিক্ষাই নিল না।
লেখক : সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকজন পরোপকারী মানুষের চির বিদায়
পরবর্তী নিবন্ধচৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ