বিশ্ববরেণ্য এক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বে গরিবের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্রঋণের জনক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।
বিডিনিউজ জানায়, ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ ও ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক্স এ যোগ দেন। পরে ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ইউনূস ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ১৯৬৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অধ্যাপক ইউনূস টেনেসির ন্যাশভিলে নাগরিক কমিটি গঠন করেন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্যান্য বাংলাদেশীদের সঙ্গে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র চালু করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অন্যদের সমর্থন আদায় এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করতে মার্কিন কংগ্রেসে লবি করার উদ্দেশ্যে তিনি এসব উদ্যোগ নেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউনূস ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার পর ইউনূস দারিদ্র্য দূরীকরণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং তার অর্থনীতি বিভাগের একাডেমিক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতি কর্মসূচি চালু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি নতুন ধরনের কৃষি সমবায় ‘নবযুগ তেভাগা খামার’ সংগঠিত করেন, যা পরবর্তীতে সরকার প্যাকেজড ইনপুট প্রোগ্রাম হিসেবে গ্রহণ করে।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্র্য কিছু পরিবারের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পর তিনি আবিষ্কার করেন যে, খুব সামান্য পরিমাণ ঋণ একজন দরিদ্র্য মানুষের জীবনে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। তিনি দরিদ্র্যদের ঋণ দেওয়ার জন্য প্রথাগত ব্যাংকগুলোর কাছে ধর্ণা দিয়ে দেখতে পেলেন তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। কারণ, ব্যাংকগুলো মনে করে গরিব মানুষ ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত নয়। অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে তিনি একটি ক্রেডিট লাইন প্রতিষ্ঠায় সফল হলেন। নিজে গরিব মানুষের ঋণের জামিনদার হয়ে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে স্থানীয় জনতা ব্যাংক থেকে তার প্রকল্পের মাধ্যমে জোবরা গ্রামের গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়া শুরু করলেন। ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর তার এই প্রকল্প পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। যার নাম হলো ‘গ্রামীণ ব্যাংক।’
গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও গত কয়েক দশকে মুহাম্মদ ইউনূস দরিদ্র বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ফোন পরিষেবা প্রদানসহ কয়েক ডজন সামাজিক কাজ করে আসছেন।
গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
২৮ জুন তার জন্মদিনকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিশ্বের ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে তার চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়।
অধ্যাপক ইউনূসের অর্জিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে– র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, সিডনি শান্তি পুরস্কার। আর বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (১৯৭৮), কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৫) এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৮৭)।
ইউনূস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।