মৌলিক পদার্থবিদ্যা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, কসমোলজি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও শেষ পরিণতির মতো জটিল বিষয়ের সরল ব্যাখ্যা দিয়ে আশির দশকে বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন ড. জামাল নজরুল ইসলাম। শুধু কি তাই? আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে তিনি প্রায় চার দশক কাজ করেছেন যার তুলনা মেলা ভার।
ডঃ জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী, ঝিনাইদহ জেলায়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ফুফাতো ভাই। তার বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিচার বিভাগীয় একজন মুন্সেফ। মা রাহাত আরা ছিলেন উর্দু ভাষার কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটিকাটি সফলভাবে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন।
স্কুল জীবনের কিছুটা সময় তাঁর কাটে কলকাতার মডেল স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলিজিয়েট স্কুলে। পাকিস্তানের মারীর লরেন্স কলেজ থেকে তিনি ও লেভেল এবং এ লেভেল পাস করেন। এরপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গণিতে বি এসসি অনার্স করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন ১৯৬০ সালে। অতঃপর বিশ্ব গণিতের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হিসাবে খ্যাত Mathematical Tripos শেষ করে কেমব্রিজ ট্রিনিটি কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে পিএইচডি এবং পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে ডি.এস.সি. ডিগ্রী অর্জন করেন।।
প্রফেসর ইসলাম তাঁর পাঁচ দশকের কর্মজীবনে বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল ধারায় কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে তাত্ত্বিক কণা, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব, মহাকর্ষ তত্ত্ব, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, আইনষ্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সূত্র, নক্ষত্রের গঠন, মহাবিশ্ব তত্ত্ব ইত্যাদি। আজকের প্রচলিত তত্ত্ব মতে মহাবিস্ফোরণের পর জন্মলগ্ন থেকে এই মহাবিশ্ব ক্রমশঃ বেলুনের মত প্রসারিত হচ্ছে। এই সমপ্রসারণের শেষ কোথায় তা বিজ্ঞানীদের জানা নেই। তবে অনেকের ধারণা, এই প্রসারণ এক সময় শেষ হবে, এবং মহাবিশ্ব ক্রমশ চুপসাতে থাকবে, যাকে বলা হচ্ছে Big Crunch. এছাড়া ২০০৩ সালে রবার্ট ক্যাডওয়েল উত্থাপন করেছেন মহাচ্ছেদন তত্ত্ব। মহাবিশ্বের ভবিষ্যত বা অন্তিম পরিণতি নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে ড. জামাল নজরুল মহাবিশ্ব যে সব সময় প্রসারিত হবে সেরকম একটি ধারণার কথা বলেন যা বিজ্ঞানবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি অংক কষে দেখিয়েছেন আগামী ১০০ বিলিয়ন বছরের মধ্যে আমাদের গ্যালাক্সি অর্থাৎ মিল্কিওয়ের সব তারার মৃত্যু হবে। হাবল টেলিস্কোপের বদান্যতায় এখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যেমন সহজ, কিন্তু আজ থেকে ৩৯ বছর আগে বিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে তাঁর ভাবীকথন ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, একটা যুগান্তকারী ব্যাপার ছিল।
অধ্যাপক জামাল নজরুল মহাজাগতিক ধ্রুবক (লামডা) নিয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি হাতে অংক কষে দেখিয়েছেন এই ধ্রুবকের মান প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ১০-৩৮ মি-২ হতে পারে। বর্তমান পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই ধ্রুবকটির মান নির্ধারিত হয়েছে সর্বোচ্চ ১০-৫২ মি-২ ।
গ্রহ-নক্ষত্রগুলো একই সরলরেখা বরাবর চলে আসবে বলে ২০০১ সালে গুজব রটেছিল যে বিশ্ব ধ্বংস হতে চলেছে। এতে সারা পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম সংখ্যাতাত্বিক গণিতের মাধ্যমে দেখান যে প্রাকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী গ্রহ-নক্ষত্রগুলো একই সরল রেখায় চলে আসছে। এতে আশংকার কিছু নেই।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের মতো বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে বের হয়েছে বিজ্ঞানী জামাল নজরুলের বেশ কয়েকটি বই। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত বই The Ultimate Fate of the Universe (মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি), বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে তাঁকে রীতিমত সেলিব্রিটি বানিয়ে দেয়। দুনিয়া কাঁপানো ফরাসী, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগীজ, সার্ব, ক্রোয়েট সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই বই। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আরো দু’টি বই, The Rotating Fields in General Relativity (1985) এবং An Introduction to Mathematical Cosmology (1992). তাঁর লেখা বইগুলো কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন, হার্ভাডের্র মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। শুধু তাই নয়, আইনস্টাইনের পর একালের সেরা বিজ্ঞানী বলে স্বীকৃত স্টিফেন হকিংয়ের বহু আগেই তিনি সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন এবং এ নিয়ে তাত্ত্বিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। জানা যায়, স্টিফেন হুকিং বিভিন্ন সেমিনারে তাঁর বক্তৃতা শুনতে যেতেন। ড. নজরুল লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে শুরু করে কেমব্রিজের Institute of Theoretical Astronomy, আমেরিকার Princeton Institute for Advanced Study (যেখানে আইস্টাইন তাঁর কর্মজীবনের শেষ দুই দশক কাটিয়েছিলেন) ও ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বের সেরা বিদ্যাপিঠে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন। তার বন্ধু তালিকায় ছিল নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, ডাইসন, রিচার্ড ফাইনমেন, আব্দুস সালাম, স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকরের মত দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানীরা।
তবে সবাইকে চমকে দিয়ে ১৯৮৪ সালে কেমব্রিজের মর্যাদাপূর্ণ চাকুরী, সুরক্ষিত জীবনের মোহ এবং গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে ফিরে এলেন পৈতৃক ভূমি চট্টগ্রামে। যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনের অধ্যাপক পদে। প্রশাসনিক অদ্ভুত জটিলতার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তাকে নেওয়া সম্ভব হয়নি। গণিতে একটা অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে তাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দেশের জন্য অপার সম্ভানাকে বিসর্জন দিয়ে স্বদেশের মাটিতে তাঁর ফিরে আসা রূপকথার গল্পেই মতই মনে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিলনা। বিদেশে আপনি যতই থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না”।
দেশে ফিরেই ডঃ জামাল নজরুল চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ে তত্ত্বীয় ও গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার জন্য Research Center for Mathematical and Physical Science (RCMPS) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান করেন, যার উদ্বোধন করেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম। পৃথিবীর সেরা গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীরা এখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।
ডঃ ইসলাম যদি বিদেশে থেকে যেতেন তাহলে অনেক আগেই নোবেল পুরস্কার পেতেন। একথা বলেছেন স্বয়ং ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। কিন্তু তাঁর স্বদেশে ফিরে আসার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ফরহাদ মাজহার লিখেছেন, “যেসব বাংলাদেশী বিদেশে আছেন তারা দেশকে কম ভালোবাসেন না। কিন্তু জামাল নজরুলের তাৎপর্য অন্যত্র। তিনি সত্যেন বোসের মত মৌলিক বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্বকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। জ্ঞানবিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম এক ঝাঁক তরুণ যারা দেশে বসেই দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াবে। জামাল নজরুল ইসলাম আমাদের সেই স্বপ্নই দেখিয়ে গিয়েছেন।” জগৎখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অখ্যাত শ্রেণীকক্ষে বসে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য তার কেমব্রিজের ল্যাব কিংবা সুপার কম্পিউটারের দরকার পড়েনি।
বিজ্ঞানের উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং শিল্প ব্যবস্থার উন্নয়নে। তিনি এডিবি, বিশ্বব্যাংকের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতেন। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের (Forum for Planned Chittagong) জন্মলগ্ন থেকেই এর সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন তিনি চট্টগ্রাম নগর ও পরিবেশ উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন।
বাঙালির রক্তে সাহিত্য রস কিংবা সঙ্গীতের ধারা থাকবেনা, সে কি হয়? বাঙালি জগতখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোস চমৎকার এগ্রাজ বাজাতেন, একটি রাগও সৃষ্টি করেছিলেন আর জগদীশ চন্দ্র বসু বাংলা ভাষাায় প্রথম সায়েন্স ফিকশানের লেখক ছিলেন। অন্যদিকে জামাল নজরুল ইসলাম ভালো গাইতে পারতেন এবং ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি ভালোবাসতেন রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত, গালিবের গজল, রফি, সায়গল ও হেমন্তের গান, বাজাতেন পিয়ানো ও সেতারে। ওস্তাদ ইমারত হোসেন এবং পন্ডিত বিজয় কিচলু তাঁর বাড়ীতে নিয়মিত আড্ডার সঙ্গী ছিলেন। তিনি মনে করতেন সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ না থাকলে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায়না।
গাণিতিক হিসাব তিনি মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাঁর বাসায় কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট সংযোগ কোনোটাই ছিলনা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,“কম্পিউটারে অনেক কাজ করা যায়, তবে সব নয়। আমার কাজের জন্য কম্পিউটার দরকার হয়না। আমি জীবনে কখনো ক্যালকুলেটর ব্যবহার করিনি। এ নিয়ে আমি গর্বিত নই, লজ্জিত নই। মাথা খাটিয়ে করলেইতো হয়!”।
ড. ইসলাম মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও উচ্চতর গবেষণা সমর্থন করতেন এবং ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন । বাংলা “কৃষ্ণবিবর”, “সমাজ দর্শন বিজ্ঞান ও অন্যান্য প্রবন্ধ” এবং “শিল্প সাহিত্য ও সমাজ” এই শিরোনামে তিনি বাংলায় তিনটি বই লিখেছেন।
২০১৩ সালে ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একজন আরাধ্য বিজ্ঞানীকে নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় বাংলাদেশী মিডিয়ার নির্লিপ্ততা ছিল সত্যিই কষ্টকর। পরিতাপের বিষয় হল এই বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী সম্পর্কে নিবিড়ভাবে তাঁর মৃত্যুর পরই জানতে পারি। জাতি হিসাবে গুণী মানুষদের সম্মান দিতে আমাদের কৃপণতার যেনো জুড়ি নেই। ২০০০ সালে তিনি একুশে পদক পেয়েছিলেন। তবে এই পদক পেতে তাঁর লেগেছিল বহুদিন। এর অনেক আগে তাঁর অনেক ছাত্র পর্যন্ত এই পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল। আমাদের সমাজে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর কদর নেই। সামাজিক মাধ্যমে কোনোকিছু ভাইরাল করে দ্রুত পরিচিতি ও খ্যাতির লাভের চেষ্টায় মত্ত সবাই। গায়ক, নায়ক কিংবা খেলোয়াড়দের বড় বড় ফ্যান ক্লাব থাকলেও বিজ্ঞানীদের ঘিরে কোনো ফ্যান ক্লাব নেই। আমাদের সমাজে ড. জামাল নজরুল ইসলামের মত ক্ষণজন্মা মনীষীদের চর্চা হয়না বলে তরুণ সমাজ আলোকিত পথের সন্ধান পাচ্ছে না। সংঘাতে জর্জরিত আজকের বিশ্বে ড. জামাল নজরুলের মত দেশপ্রেমিক, পরোপকারী ও নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানীর খুবই প্রয়োজন।
লেখক: প্রকৌশলী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ