চলচ্চিত্রাকাশের নক্ষত্ররা একের পর এক সুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছেন। এঁদের বর্ণাঢ্য শিল্পী জীবনের আলোকচ্ছটা চতুর্দিক আলোকময় করে রাখতো। এঁদের কেউ নির্মাতা, কেউ অভিনয় শিল্পী, কেউবা কন্ঠশিল্পী, কেউ কলাকুশলী, আবার কেউ প্রযোজক। সাধারণত আমরা স্টার বলতে অভিনয় শিল্পীদেরকে বুঝি। কিন্তু প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথিতযশা শিল্পী মাত্রই স্টার বা নক্ষত্র। দুঃখের কথা এঁরা আর কয়েকজন মাত্র আমাদের মধ্যে রয়েছেন। গত কয়েক দশকে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন এ–ধরনের প্রভাবশালী শিল্পী কলাকুশলীকে আবির্ভুত হতে দেখা গেছে।
জিনা লোলোব্রিজিদার প্রয়াণের পর কথাগুলি বড় বেদনার মতো বাজছে বুকে। জিনা লোলোব্রিজিদা–সিনেমা দুনিয়ার এক মহা উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি ছিলেন সাধারণ ও প্রাগ্রসর উভয় শ্রেণির দর্শকের কাছে বরণীয় অভিনেত্রী হয়ে। গ্ল্যামার এবং ইনটেলেকচুয়ালিটির সমন্বয়ে অভিনব এক অভিনয় শৈলি গড়ে তুলেছিলেন জিনা। অপরূপ দেহসৌষ্ঠর এবং অত্যন্ত সাবলীল অভিনয় ক্ষমতার গুণে রীতিমত অবিস্মরণীয়তা পেয়ে গিয়েছিলেন জিনা। যা তাঁকে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল।
জিনা লোলোব্রিজিদা ইতালির চলচ্চিত্র শিল্পে যখন অভিনয় করতে আসেন, সেই ১৯৫০–এর দশকে, ইতালির চলচ্চিত্র জগতের তখন স্বর্ণযুগ। ডাকসাইটে সব পরিচালকেরা তখন ছবি তৈরি করছেন, অভিনয় করছেন মহাতারকা সব অভিনয় শিল্পীরা। এঁদের মধ্যে জিনার আগমন ছিল যেন সোনায় সোহাগা। জুলিয়েতা মাসানি, অনিতা একবার্গ, মনিকা ভিপ্তি, অ্যানা ম্যাগনানি, সিলভানা ম্যাঙ্গানো, ক্লদিয়া কার্দিনেল এবং সোফিয়া লোরেন তখন ইতালির সিনেমা জগতের ভুবন মাতানো সব অভিনেত্রী। ইতালির নিও রিয়ালিজম চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রভাবে পুরো চলচ্চিত্রবিশ্ব তখন প্রভাবিত। এহেন সময়ে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সাথে জিনার বিচরণ। তবে তিনি তাঁর ব্যতিক্রমী অভিনয় আঙ্গিক; যা ছিল সম্মোহনী সৌন্দর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও স্বতস্ফূর্ত অভিনয়ের মিশেলে তৈরি, তা দিয়ে কেবল ইতালি নয়, সমগ্র সিনেমা দুনিয়াকে বশ করে নিতে পেরেছিলেন অল্প সময়ে। ‘লাস্যময়ী’ শব্দটিকে তিনি নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতায় উত্তীর্ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে।
জিনার পুরো নাম লুইজিনা লোলোব্রিজিদা। সিনেমায় হয়ে যান জিনা লোল্লোব্রিজিদা। ‘সুন্দরীশ্রেষ্ঠা’ অভিধায় নন্দিত অভিনেত্রীর জন্ম ৪ জুলাই ১৯২৭ ইতালির সাবিয়াকো শহরে। The Most Beautiful Women of World Cinema বলা হতো তাঁকে। তাঁর পিতা ছিলেন আসবাবপত্র ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে তাঁরা স্থিত হন রোমে। সেখানে জিনা টুকটাক অভিনয়ের পাশাপাশি ডায়ানা লরিস নামে মডেলিংও করতে থাকেন। পাশাপাশি পড়াশোনা করতে থাকেন চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে। মডেলিংও করতে থাকেন। পাশাপাশি পড়াশোনা করতে থাকেন চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে। মডেলিং–এ যথেষ্ট পরিচিতি পেয়ে যাবার কারণে ইতালিয় চিত্রনির্মাতাদের নজরে পড়েন। ১৯৪৬ সালে একুইলা নেরা (রিটার্ন অফ দ্য ব্ল্যাক) ছবিতে একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর ফিল্ম ক্যারিয়ারের শুরু। কয়েকটি ছবিতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ের পর ১৯৪৯ সাল থেকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেতে থাকেন। এ–সময়ে ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালকদের দৃষ্টি পড়ে জিনার ওপর। ধীরে ধীরে হলিউডেও পরিচিতি পেতে থাকেন। ডাক পেয়ে যান সেখান থেকে ক্যারিয়ারের প্রায় শুরুর দিকেই।
১৯৫৩ সালে হলিউডে প্রথম অভিনয় করেন জন হাডসন পরিচালিত বিট দ্য ডেভিল ছবিতে হামফ্রে বোগার্টের বিপরীতে। এটি ছিল ইংরেজি ভাষায় তাঁর প্রথম ছবি। এই ছবিতেই তাঁর বাজিমাত হয়ে যায় হলিউডে। এরপর একে এক অভিনয় করতে থাকেন ফ্রাংক সিনাদ্রা, বার্ট ল্যাংকাস্টার, রক হাডসন, ইয়ুল ব্রায়নার, এন্থনি কুইন–এর মতো শক্তিমান অভিনেতাদের বিপরীতে। একই সাথে ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের ছবিতে বিশেষ করে ফ্রান্সেও কাজ করতে থাকেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৯৭–৫১ বছরের এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অভিনীত ছবির সংখ্যা ৫০। তবে তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় ছবি দি হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম (১৯৫৬), সলোমন এন্ড শেবা (৫৯), কাম সেপ্টেম্বর (৬১)। এই তিনটি ছবি তাঁকে অমর করে রেখেছে। তিনটি ছবির ধরন তিন রকম। প্রথমটি ফ্রান্সে নির্মিত। পরের দুটি হলিউডে। তাঁর অভিনীত আর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র; এলিনা (১৯৫০) বিউটিফুল বাট ডেঞ্জারাস (১৯৫৫), বিট দ্য ডেভিল(৫৩), ওমেন অফ রোম (৫৪), দি এডভেঞ্চার অফ পিনোচিও, দি ডলস (৬৫), ম্যাড সি (৬৩), হোটেল প্যারাডাইসে (৬৬), দি লোনলি ওমেন (৭৩), এ হানড্রেড এন্ড ওয়ান নাইটস (৯৫)। শেষ ছবি XXL (১৯৯৭)। ১৯৭০ সাল থেকে জিনা অভিনয় কমিয়ে দেন। এসময় তিনি মনোনিবেশ করেন ফটোগ্রাফিতে। ক্রমশ তিনি চিত্র সাংবাদিকতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেশ সাফল্য আসে তাঁর এই দ্বিতীয় পেশায়। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তোলা ছবি নিয়ে বই ইতালিয়া মিয়া। এরপরে প্রকাশিত তাঁর ফটোগ্রাফির আরো তিনটি বই। ফটোগ্রাফির পাশাপাশি তিনি ভাস্কর্যের কাজও করতে থাকেন যার প্রশিক্ষণ তিনি নিয়েছিলেন কৈশোরে। এক সময়ে রাজনীতিতেও জড়িত হন। পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিফল হলেও এ–পথ থেকে সরে আসেননি। ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেয়ার পর শেষ পর্যন্ত ছিলেন পেশাদার আলোকচিত্রী।
জিনা লোলোব্রিজিদার ক্যারিয়ারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে নিয়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ‘রিট্রোট্টো দি ফিদেল’ নামের ছবিটি তিনি নির্মাণ করেন ১৯৭২ সালে। ছবিটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়।
দীর্ঘ ৯৫ বছরের বর্ণময় জীবন কাটিয়ে গেলেন জিনা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কয়েকমাস হাসপাতালে শয্যাশায়ী থাকার পর রোমের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচারের ধকল সয়নি তাঁর প্রায় শতায়ু শরীর। আবার ভর্তি হন ক্লিনিকে। জানুয়ারির (২০২৩) ১৬ তারিখে চিকিৎসারত অবস্থায় প্রয়াত হলেন কিংবদন্তী এই শিল্পী। এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটলো বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরেকটি বর্ণিল অধ্যায়ের।