বিশ্ব হার্ট দিবস ও বাংলাদেশে হৃদরোগ নিবারণ

অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ | রবিবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ভূমিকা : আদিকাল থেকে হৃদয় তথা হৃদপিণ্ড মানুষের কাছে এক বিমুগ্ধ বিস্ময়। ইংরেজি ‘হার্ট’ আর তার বাংলা প্রতিশব্দ ‘হৃদয়’ কিংবা ‘হৃদপিণ্ড’। এই দু’টোর মধ্যে পার্থক্য কিঞ্চিৎ বিদ্যমান। যেমন, হৃদয়হীন মানুষ হতে পারে কিন্তু হৃৎপিণ্ডহীন মানুষ অকল্পনীয়। তবে সাধারণের কাছে এই দ’ুটো সমার্থক। হার্ট নিয়ে যত উদ্ধৃতি আর যত ধরনের রূপকাঞ্জলি সাহিত্যে, সংগীতে কিংবা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রচলিত আছে তা আর কোনো বিষয়ে দেখা যায় না। সকল কৃষ্টি ও ধর্মীয় বিশ্বাসে হৃৎপিণ্ডকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করা হয়। হৃৎপিণ্ড ভালোবাসার উৎপত্তিস্থল, আবেগের উৎস আর সাহসের ঠিকানা। শরীরবৃত্তিয়ভাবে হৃৎপিণ্ড দিয়ে জীবন শুরু; তা বন্ধ হলেই জীবনাবসান।

 হৃদরোগের সেকাল একাল : বর্তমানে পৃথিবীতে হৃদরোগ মৃত্যুর প্রধানতম কারণ। তবে অনেকদিন যাবৎ মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস ছিল যে হৃৎপিণ্ড সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব সৃষ্টি। তাকে কোন রোগ বালাই স্পর্শ করতে পারে না। কাল প্রবাহে এই ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে হৃদরোগ দেখা দিয়েছে। তার প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বেড়ে বর্তমানে হৃদরোগ মৃত্যুর এক নম্বর কারণ। আবার এই ধারণাও অনেকদিন ধরে বলবৎ ছিল যে হৃদরোগ পাশ্চাত্যের ধনাঢ্য সমাজের অসুখ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এই রোগে আক্রান্ত হয় না। কালক্রমে তাও ভূল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে হৃদরোগের প্রকোপ উন্নতবিশ্বে নিম্নমুখী এবং তা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ সমূহে ক্রমবর্ধমান। বর্তমানে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৮০ ভাগই ঘটে এখানে। হৃদরোগের প্রকোপ দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মতে তা এখানে এক বিকাশমান ও অভিনব মহামারী। অদূর ভবিষ্যতে তা পরিপূর্ণ মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করবে।

 বাংলাদেশে কেন বাড়ছে হৃদরোগ : হৃদরোগ অনেকটাই মানবসৃষ্ট। সভ্যতার বিকাশের সাথে এবং আধুনিকতার ছোয়ায় খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন তা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। অর্থনৈতিক উন্নতি ও আধুনিকায়নের পাশাপাশি এখানেও পড়েছে বিশ্বায়নের প্রভাব। এতে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা, পরিবর্তিত হয়েছে খাদ্যভ্যাস ও জীবনযাত্রা। প্রতিযোগীতামূলক জীবন যাত্রায় বাড়ছে মানসিক চাপ আর কমছে কায়িক শ্রম ও ব্যায়ামের সুযোগ। তার সাথে বাড়ছে মেদবাহুল্য, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের কোলেষ্টেরল ও ধূমপান। বিখ্যাত ‘ইন্টারহার্ট’ গবেষণা দেখিয়েছে যে এখানে হৃদরোগ সৃষ্টির কারণ ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের কোলেস্টেরল, মেদবাহুল্য, কায়িকশ্রম ও ব্যায়ামের অভাব, ভ্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস তথা কম ফলমূল ও সবুজ সবজী গ্রহণ এবং মানসিক চাপ।এই সমীক্ষা আরো দেখিয়েছে বাংলাদেশীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এখানে তারা কম বয়সে (৪০ বছরের নিচে) হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকে।

 হৃদরোগ নিবারণ : হৃদরোগের কারণ করোনারী রক্তনালীতে কোলেষ্টেরল তথা চর্বি জমে তা সরু হয়ে পড়া। এই প্রতিবন্ধকতার গায়ে রক্ত জমাট বেধে তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়লেই ঘটে হৃৎপেশীর পচন। এটাই হার্ট অ্যাটাক। হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের সংশ্রবে আসা থেকে শুরু করে হৃদরোগ সৃষ্টি পর্যন্ত লাগে দীর্ঘ সময় । অর্থাৎ এই রোগের সুপ্তিকলে (incubation period) দীর্ঘ। তাই তার নিবারণ বা প্রতিরোধেও পাওয়া যায় লম্বা সময়। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যকারিতাও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান নিয়ন্ত্রণে তার সৃষ্টি, অগ্রগতি এবং জটিলতা বন্ধ করা যায়।

 তিন পর্যায়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে :

 মৌলিক প্রতিরোধ : হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি ঠেকিয়ে দেওয়াই মৌলিক প্রতিরোধ। এই ব্যবস্থায় সমগ্র জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিরোধ গ্রহণ করা হয়। এর সাথে জড়িত সামাজিক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। জীবনযাত্রার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও জীবনমান উন্নয়ন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এতে এমন এক প্রজন্ম তৈরী করা হয় যার মধ্যে হৃদরোগ ঝুঁকি সর্বনিম্ন কিংবা তা অনুপস্থিত। এই ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ। তবে তার সুফল দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসহ।

 প্রাথমিক প্রতিরোধ : এতে ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে দেখা দেওয়া হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করে হৃদরোগ সৃষ্টি প্রতিরোধ করা হয়। জীবনযাত্রার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবর্তন আনয়ন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও উপযুক্ত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে তা করা হয়।

 মাধ্যমিক প্রতিরোধ : মৌলিক ও প্রাথমিক স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের পরও অনাকাঙ্ক্ষিত হৃদরোগ দেখা দিলে তখন এই ব্যবস্থা। হৃদরোগীদের স্বাস্থ্যসংকট অদূর ভবিষ্যতে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। তা অকালমৃত্যু ও ভোগান্তির কারণ হয়। তাই জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের প্রভূত পরিবর্তন, নিবিড় ওষুধ চিকিৎসা, আধুনিক ইন্টারভেনশনাল ও শল্য চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে হৃদরোগের অগ্রগতি থামিয়ে জীবনমান ও আয়ু বৃদ্ধি করাই মাধ্যমিক স্তরের প্রতিরোধ।

উপরোক্ত তিন স্তরের প্রতিরোধের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে প্রতিরোধের দিকেই দৃষ্টি দেওয়া হয় বেশি। যদিও তা এই বিশাল স্বাস্থ্য সমস্যার আংশিক সমাধান মাত্র।

 করণীয় : যেহেতু পরিবর্তিত জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসই হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করে তাই তার পরিবর্তনই হৃদরোগ নিবারণে আবশ্যকীয় পদক্ষেপ।

 স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাদ্যভ্যাস গড়ে তোলা : ‘Global Burden of Disease’ সমীক্ষা দেখিয়েছে খাদ্যাভ্যাসসহ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস রক্তের কোলেস্টেরল, মেদ বাহুল্য এবং এসবের পরিণাম হৃদরোগের নিয়ন্ত্রণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে খাবার হবে উদ্ভিদজাত ও সবুজ শাকসবজি সমৃদ্ধ। তা হবে কম চর্বিযুক্ত (৩০% এর নিচে), লবণ সীমিত (দৈনিক ৫ গ্রামের নীচে) ও কম চিনিযুক্ত (দৈনিক ৫০ গ্রামের নীচে)। খাবারে দৈনিক ৪০০৫০০ গ্রাম ফলমূল ও সবুজ শাকসবজি গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যদেশ সমূহ ২০২৫ সালের মধ্যে খাবারের লবণ ৩০% কমিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে।

 ধূমপান ও তামাক দ্রব্য বর্জন : সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে বাংলাদেশের শতকরা ৪৭.৩ জন প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপান ও তামাক সেবন করে। এখনও ধূমপান বাংলাদেশে হৃদরোগের প্রধান কারণ। ধূমপান বিরোধী কর্মকান্ড জোরদার করা এবং ধূমপান ও তামাক নিরোধী আইনের যথাযত প্রয়োগের মাধ্যমে তার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

 মেদ বাহুল্য নিয়ন্ত্রণ : শারীরিক ওজন শতকরা ৫ ভাগ কমাতে পারলে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজ কমে আসে। পূর্বে উল্লেখিত খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম, সদা কর্মমুখর থাকা ও অলসতা পরিহার মেদবাহুল্য নিয়ন্ত্রণ ও শরীরের আদর্শ ওজন ধরে রাখতে কার্যকর।

 শারীরিক কর্মসাধন ও ব্যায়াম : সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম (যেমন হাটা, গৃহস্থালীর কাজ, সাইকেল চালানো, সাতার, নৃত্য) কিংবা ৭৫ মিনিট তীব্র মাত্রার ব্যায়াম (যেমন জগিং, দৌড়ানো, টেনিস, প্রতিযোগীতামূলক সাঁতার) সুপারিশ করা হয়। দীর্ঘ সময় বসে থাকা, শুয়ে থাকা, টেলিভিশন দেখা, মোবাইল চালানো অলস জীবনযাত্রার অংশ। এসব বর্জন আবশ্যক। হৃদরোগী, অলস ও ব্যায়ামে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ধীরলয়ে ব্যায়াম শুরু করবেন এবং তার মাত্রা ও তীব্রতা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করবেন। হৃদরোগীদের ব্যায়াম শুরুর আগে চিকিৎসকদের পরামর্শ আবশ্যক।

 মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ : দুচিন্তা, হতাশা, একাকিত্ব কর্মক্ষেত্রের চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তা নিয়ন্ত্রণে সাইকোথেরাপি, প্রার্থনা, মেডিটেশন ও অন্যান্য চাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ আবশ্যক।

 নিয়মিত চেক আপ : এদেশে হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের উচ্চহার বিবেচনায় প্রাপ্ত বয়স্ক সকলের জন্য তার উপস্থিতি খতিয়ে দেখা বাঞ্ছনীয়। প্রাপ্তবয়স্ক যারা হৃদরোগ থেকে মুক্ত তারা প্রতিবছর এবং যারা হৃদরোগী তাদের নিদিষ্ট সময় অন্তর চেক আপ আবশ্যক। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তা নির্ধারণ করবেন।

 নিয়মিত ওষুধ সেবন : উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের উচ্চ কোলেষ্টেরল নিয়ন্ত্রণে তা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক প্রতিরোধ সাফল্য মন্ডিত হয়।

 উপসংহার : প্রাণঘাতি হৃদরোগের কোন স্থায়ী উপশম নেই। তবে বিভিন্ন স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় তা থেকে মুক্ত থেকে দীর্ঘ জীবন লাভ সম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে আজ ২৯শে সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ৯০টি দেশে বিভিন্ন সচেতনতামূলক ও হৃদরোগ নিবারণ কর্মসূচির মাধ্যমে এই দিবস পালিত হয়। “কর্মে হার্টকে ব্যবহার করুন” এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ওয়াল্ড হার্ট ফেডারেশন এবং তার অধিভুক্ত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন সহ সকল হৃদরোগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তা উদযাপনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। হৃদরোগ নিবারণ কর্মকাণ্ডে হৃদয়কে ব্যবহার করে সকলের জন্য সুস্থ, উৎপাদনশীল ও উপভোগ্য জীবন মাধ্যমে এই দিবস উদযাপন সার্থকতা লাভ করুক। এটিই হোক আজকের প্রত্যাশা।

লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন,

সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ