শিক্ষা, সংস্কৃতি ব্যতিরেকে কোন দেশ ঋদ্ধ হতে পারে না। সুস্থ ধারায়, সুশৃঙ্খল দেশ পরিচালনায় সু-শিক্ষিত জনের কোন বিকল্প নেই। দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন জনগণের দোরগোড়ায় শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। যাঁরা এই মহান কাজ করেন তাঁরাই তো শিক্ষক। প্রতিনিয়ত বঞ্চনা আর অবহেলা এই সমাজের পুরস্কার। যতক্ষণ না আমরা এই বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছু দিয়ে মূল্যবোধ ভেঙে পড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। প্রতিমুহূর্তে কাঁটাছেড়া করছেন শিক্ষাকে। তথাকথিত বিশেষজ্ঞ দল ঠাণ্ডা কক্ষের কল্পনাপ্রসূত চিন্তার দূষণ ছড়িয়ে বিভ্রান্তি এবং অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে জাতিকে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, মানুষের ছাগল খাওয়া আর বাঘের ছাগল খাওয়া এক নয়। সুস্থ ধারায় শিক্ষাকে নিয়ে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে মানবিক গুণ সম্পন্ন জন সম্পদ তৈরী এখন সময়ের দাবি।
সেই মানবিক গুণ সমৃদ্ধ মানব সম্পদ তৈরীতে সদা সক্রিয় শিক্ষক সমাজ। অনাদর, অবহেলা, বৈষম্য তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলছে এবং এগিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে।
রবীন্দ্রনাথের মতে ‘দেশকে শিক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের গরজ। যা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সেইজন্য ইউরোপ, জাপান, আমেরিকায় শিক্ষার কৃপণতা নেই। দুঃখের বিষয় কেবল আমাদের গরীব দেশেই শিক্ষাকে দুর্মূল্য ও দুর্লভ ক্রিয়া তোলাই দেশের মঙ্গল -একথা উচ্চাসনে বসিয়া যত উচ্চৈঃস্বরে বলা হইবে বেসুর ততই উচ্চ সপ্তকে উঠিবে।’
শিক্ষা হতে হবে সর্বজনীন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগালে এবং তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করণের লক্ষ্যে। এর ব্যতয় সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে বিনষ্টির দিকে। বিনষ্টি এবং বিধ্বস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমার ভূখণ্ডের জাতিগোষ্ঠীর উপযোগী করে তুলতে হবে শিক্ষাকে। তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উপনীত করে স্থিতিশীল পাঠক্রম পাঠ্যসূচী প্রণয়ন জরুরি। ক্ষণে ক্ষণে পাঠক্রম পাঠ্যসূচীর রদবদল শিক্ষার ধারাকে বাধাগ্রস্ত করে শুরু হয় অসাধু মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য সর্বোপরি শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য। শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড তাহলে শিক্ষক হলো শিক্ষার মেরুদণ্ড। শিক্ষাব্রতীদের নিয়ে আরো বেশি যত্নবান হতে হবে। সরকারি বেসরকারি বিভাজন এবং বিভিন্ন ধারার শিক্ষাকে একই পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সাধারণ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। যে কোনো চালাকি বিপর্যয় রোধে ব্যর্থ হবে নিশ্চিত। কবিগুরুর ভাষায় –
‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করিনা, আরম্ভর করি কাজ করিনা। যাহা অনুষ্ঠান করি, বিশ্বাস করিনা, ভুরি পরিমাণ বাক্য রচনা করি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারিনা। আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করিনা। আমরা অন্যের সাহায্য প্রত্যাশা করি, বিন্দু পরিমাণ কাহাকেও সাহায্য করিনা। আত্মসমালোচনা করি না, কিন্তু অন্যের সমালোচনায় গগন বিদীর্ণ করি’।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং নেতিবাচকতা পরিহার করে ইতিবাচক হতে হবে। যেকোনো মূল্যে শিক্ষাকে রাখতে হবে সবকিছুর উর্ধে। শিক্ষায় অস্থিরতা কখনো কাম্য নয়। অস্থির সমাজ যেমন কৃতি পুরুষ সৃষ্টি করতে পারে না তেমনি অস্থির শিক্ষা মেধাবী রাষ্ট্র গঠনে অক্ষম। যার প্রেক্ষিতে যেকোনো শুভ অর্জন বিসর্জনে পর্যবসিত হবে। সমাজ এবং রাষ্ট্রে অবক্ষয় রোধে সুশিক্ষায় দেশপ্রেমিক সুনাগরিক তৈরী জরুরি। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে- যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন সহজ।কিন্তু অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজ পুণনির্মাণ সহজ নয়। তাই অবক্ষয় রোধে শিক্ষায় খুব বেশি মনোযোগী হতে হবে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। জীবন চেতনা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রুচি চাহিদা ও জীবনের মান বেড়েছে। শিকার প্রসার হয়েছে, বিভিন্ন প্রচার ও সামাজিক মাধ্যম আমাদের বিশ্বসচেতন ও আন্তর্জাতিক করে তুলেছে। ভোগ বিলাসের দুর্দমনীয় চাহিদা সঞ্চয়োন্মাদ করে তুলছে। বিত্তের পরিধি ক্রমাগত বাড়ছে অপরদিকে চিত্তের পরিধি পলে পলে সংকুচিত হচ্ছে। মানবিক গুণের বিকাশ বিস্তার রুদ্ধ হচ্ছে। চারদিকে অশিক্ষা কুশিক্ষার বিরুদ্ধে নিয়ত লড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এহেন সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষক ও সুশিক্ষা। এক মনীষী বলেছেন – যুদ্ধ জয় নির্ভর করে সেনাপতির ওপর, কেবল সৈন্যদলের ওপর নয়।যদি সেনাপতি একটি ক্ষুদ্র সেনাগোষ্ঠীর মনে সাহস ও মনোবল চাঙা রাখতে পারেন তাহলে একটি বড় সেনাবাহিনীও তাদের পরাজিত করতে পারে না। আর এক্ষেত্রে সেই সেনাপতি হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকদেরও হতে হবে আদর্শান্বিত শ্রেয়নিষ্ঠ প্রেষ্ঠানুগ। ‘শিক্ষকের নাই ইষ্টে টান, কে জাগাবে ছাত্র প্রাণ’।
শিক্ষকদের আর্থসামাজিক মর্যাদা সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে। বিভেদ বৈষম্যের দৃশ্য অদৃশ্য প্রাচীর ভাঙতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। শিক্ষকদেরও তৈরী থাকতে হবে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে। আঞ্চলিকতাকে নিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিকতায়।
রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘শিক্ষক হবেন প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি মনে করেন, শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আত্মীয়তার সম্বন্ধ থাকা চাই। শিক্ষকের কাজ শুধু পুঁথি থেকে শুষ্ক তত্ত্ব ও তথ্য বিতরণ নয়। শিক্ষক সবসময় আনন্দের সঙ্গে অনন্তের ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীর সমগ্র জীবন ভরে তুলবেন। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু ও পথ প্রদর্শক। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। তিনি ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে গুরুর অন্তরে ছেলেমানুষটি একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তিনি ছেলেদের ভার নেবার অযোগ্য। উভয়ের মধ্যে শুধু সামীপ্য নয়, আন্তরিক সাযুজ্য ও সাদৃশ্য থাকা চাই, এই যে দেনা-পাওনার নাড়ির যোগ থাকে না।’
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক সুখী সমৃদ্ধ স্থিতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন তেমনি তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি বিশ্ব মানবতার মূর্তপ্রতীক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষায় সকল বৈষম্যের নিরসন ঘটিয়ে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ পূর্বক বহুধাবিভক্ত শিক্ষা রদ করে একই ধারার একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়ন করে মুজিব জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে মহিমান্বিত করে তুলবেন। প্রজন্মের জন্য রচিত হোক নতুন ইতিহাস। জয় হোক শিক্ষাব্রতীদের।
লেখক : শিক্ষক, সংস্কৃতি সংগঠক