ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় লাগামহীন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা মুসলিম বিশ্ব। তাই এবারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের মূল এজেন্ডা ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধ এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা। প্রায় সব বিশ্ব নেতাই তাদের ভাষণে এ বিষয়ে কথা বলছেন। অধিবেশনে প্রায় সব নেতা গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সমর্থন করে আসছে। ট্রাম্প তার ভাষণে গাজার ভয়ানক মানবিক সংকটের কথা উল্লেখ করেননি। বরং পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনায়ও তিনি ব্যস্ত ছিলেন। ট্রাম্প বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হামাসকে পুরস্কারের শামিল। এতে সমস্যা সমাধান না হয়ে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গত ১৫ই আগস্ট ২০২৫ আলাস্কায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বৈঠকে অনেকেই মনে করেছিলেন বিশ্বের দুই পরাশক্তি যখন বৈঠকে যাচ্ছে তখন হয়তো সংঘাতময় অনেক কিছুর সুরাহা হবে এবং এটি সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সংবাদমাধ্যমের সামনে তারা শুধু বললেন, একটি স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আমাদের এই সংঘাতের মূল কারণগুলো নিরসন করতে হবে, সংঘাতের মূল কারণ দূর না হলে স্থায়ী শান্তি আসবে না। কিন্তু তারা এ শীর্ষ বৈঠকের তাৎপর্য কী ও অগ্রগতির প্রকৃত চিত্র কী, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব কল্পনার ওপরই থেকে গেল। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া তারা নিজেদের শান্তিরদূত ও চুক্তির কারিগর হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াসহ জি–৭ ভুক্ত দেশগুলির ভাবখানা এমন, আমরা কোনো টাকা খরচ করছি না অন্যরা আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে আর আমরা অস্ত্র বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছি। আশা ছিল শান্তির সুবাতাস বইবে পৃথিবীতে, কিন্তু শান্তির আশাবাদী মানুষগুলোকে হতাশ হতে হলো।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন ঘটনা খুব কম ঘটেছে, যখন শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশগুলোর নেতাদের বৈঠক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর সমাধান দিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে যত বড় বৈঠক বা চুক্তি হোক না কেন, সেগুলো স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে ফলপ্রসু হয়নি কদাচিৎ বিশ্ব রাজনীতির গতি–প্রকৃতি বদলেছে মাত্র। বর্তমান পৃথিবীতে অর্থনৈতিকভাবে এবং সমরাস্ত্রের সম্ভারে পরিপূর্ণ দেশ হিসেবে পৃথিবীতে এক নম্বর দেশ যুক্তরাষ্ট্র,সাথে জোটবদ্ধ জি–৭ ভুক্ত অন্য ছয়টি দেশ কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, সঙ্গে আরও কিছু দেশ আছে যেমন অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত অন্যান্য দেশগুলো। যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্র যা বলে সেই একই সুরে কথা বলে, একই নীতি অনুসরণ করে। কৌশলগত প্রশ্নে যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশও অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাশিয়া কয়েক দশকের দুর্বলতা কাটিয়ে এখন নতুন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠেছে! আর রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার ডজন খানেক দেশ। বর্তমান বিশ্বে ভূ–রাজনীতি অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন চীন অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তারাও সমরাস্ত্রের সম্ভার শক্তিশালী করে আমেরিকা এবং তার জোটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। উপরন্ত বিশ্বের ক্ষমতাধর চতুর্থ শক্তি হিসেবে আগমন ঘটেছে ভারতের।
এখন পরাশক্তিগুলোর গোঁয়ার্তুমির জন্য সারা পৃথিবী যুদ্ধ দ্বারা আক্রান্ত, অতীতের অন্য সব সময়ের চেয়ে বর্তমানে যুদ্ধ পরিস্থিতির ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধবিরতি বা শান্তি প্রক্রিয়া এখনো অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। মনে হয় যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব আয়োজন সম্পন্ন। বিশ্ব রাজনীতি এগোচ্ছে আরও অনিশ্চয়তার দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজের হাতেই আছে তিন হাজারেরও অধিক পারমাণবিক বোমা কিন্তু তারাই এ অবস্থায় পারমাণবিক বোমা নিরস্ত্রীকরণের কথা বলছে যা রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়াসহ অন্যান্য পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশসমূহ স্বাভাবিকভাবেই মানতে পারছে না। এমনকি সংখ্যায় কম হলেও ভারত, পাকিস্তানের হাতেও আছে পরমাণু অস্ত্র। এখন শুধু সমরাস্ত্রের লড়াই নয়, পাশাপাশি চলে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত লড়াই এর প্রভাব চোখে দেখা না গেলেও, জনজীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য লড়াই এই দুই দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত সংঘাতে বিশ্বের বহু দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সংঘাত যত ব্যাপক এবং আন্তর্জাতিকীকরণের দিকে যাচ্ছে, জটিলতা ততই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান অর্জনের সম্ভাবনা হ্রাস পাচ্ছে। বন্ধ হয়নি কোন যুদ্ধ, সংঘাত বা আগ্রাসন, বন্ধ হয়নি প্যালেস্টাইন– ইসরাইল, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ অথবা তাইওয়ানের উপর চীনের দাদাগিরি। প্রতিদিন ইউক্রেন আর গাজায় নিহত হচ্ছে শত শত মানুষ। সংঘাত অনিবার্য জেনেও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো এখনো সমরাস্ত্র বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় রয়েছে। উপরন্তু যোগ হয়েছে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ এর মত অর্থনৈতিক যুদ্ধ। সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পশ্চিম এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।
পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, দমন, পীড়ন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর খবরদারি করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ে যখন বিভিন্ন দেশ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন তা সমাধানের জন্য জাতিসংঘ এগিয়ে আসে এবং তা প্রস্তাব আকারে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হয়। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে ১১টি সদস্য দেশ থাকলেও কোন প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ৫টি স্থায়ী সদস্যদের কেউ ভেটো বা অনুপস্থিত থাকলে ঐ প্রস্তাবটি আর পাশ হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক সংঘাতময় বিষয়ের সমাধান হয় না। তাদের এইরূপ কর্মকাণ্ডে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হউক বা শান্তি প্রতিষ্ঠা হউক সেই বিষয়টি চায় না। পরাশক্তি সমূহ অন্যকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে নিষেধ করছে অথবা ধ্বংস করতে বলছে, কিন্তু তাদের কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে সেটি তারা ধ্বংস করতে চায় না, ভাবখানা এমন– ‘তুমি রাখলে পাপ, আর আমার কাছে থাকলে সেটা তোমার জন্যও পুণ্য’। তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের পরাশক্তি সমূহ নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সামরিক এবং অর্থনৈতিক কারণে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অশান্তির বীজ বপন করে।
বিশ্বের পরাশক্তিগুলো একদিকে শান্তির কথা বলছে অন্যদিকে বিভিন্ন দেশকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সাহায্য করছে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী পরাশক্তিগুলো যদি নিরপেক্ষভাবে বিশ্ব শান্তির জন্য কাজ করতো তাহলে সংঘাতময় এই পৃথিবী সকলের জন্য সুন্দর হতো।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।