১) ন্যাশ দিবসের পটভূমি :
ন্যাশ একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস হলো ফ্যাটি লিভার সম্বন্ধে ব্যাপক জন সচেতনতা তৈরির জন্য প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো আরো ভালোভাবে ফ্যাটি লিভার রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা। প্রতিরোধ যোগ্য এই রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতার লক্ষ্যে গ্লোবাল লিভার ইনস্টিটিউট কর্তৃক ১২ই জুন ২০১৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবার গ্লোবাল লিভার ইনস্টিটিউট ৯ই জুন ৫ম বার্ষিক আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস ঘোষণা করেন। STOP NASH থিম নিয়ে এবারের ন্যাশ দিবস পালিত হচ্ছে। রোগটির পরিচিতি নতুন হলেও বিশ্বব্যাপী এই ন্যাশ এখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও একইভাবে বিস্তার ঘটছে ন্যাশের।
২) ন্যাশ কি :
ন্যাশ হলো ফ্যাটি লিভার রোগ এর একটি গুরুতর রূপ, যাকে আমরা বলে থাকি নন অ্যালকোহলিক স্টেটোহেপাটাইটিস। আর ফ্যাটি লিভার হলো লিভারের মধ্যে চর্বি জমা। সাধারণত লিভারে ৫% এর অধিক চর্বি জমাকে আমরা ফ্যাটি লিভার বলে থাকি। ন্যাশ হলো একাট ক্রনিক রোগ। আমরা দেখতে পাই ১০০ জন ফ্যাটি লিভার রোগীর মধ্যে প্রায় ১০% জনই ন্যাশে আক্রান্ত। ন্যাশ স্থুলতা এবং ডায়াবেটিসের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু এর লক্ষণগুলি প্রায়শই দেখা যায় না, তাই ন্যাশ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। ন্যাশ লাইফস্টাইল দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় যেমন, দীর্ঘস্থায়ী অত্যাধিক ক্যালরি গ্রহন এবং কম পরিমাণ শারীরিক শ্রম এর অন্যতম প্রধান কারণ তাই এটিকে আমরা মডার্ন লাইফস্টাইল রোগ বলতে পারি। যদিও বা এতদিন যাবত এ ধারণা পোষন করা হতো যে, স্থুল ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি, কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, কৃশ ব্যক্তিদের মধ্যেও এই রোগের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
৩) ন্যাশ রোগের উপসর্গ: বা কতটু্কু ঝুঁকিপূর্ণ বা এর ভয়াবহতা :
ন্যাশ এর উপসর্গগুলি প্রায়ই অদৃশ্য থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ন্যাশ এর ঝুঁকির কারণগুলি বোঝা ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের সঠিক রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করতে পারে। ন্যাশ রোগীদের কার্ডিওমেটাবলিক অবস্থার অবনতি ঘটায় এবং এটি কার্ডিওভাসকুলার ইভেন্টের কারণে মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত। ন্যাশ রোগীদের মধ্যে ৩৮% পর্যন্ত মৃত্যু সরাসরি কার্ডিওভাসকুলার (হৃদরোগ) ঘটনাগুলির সাথে সম্পর্কিত। ন্যাশ হেপাটাসেলুলার বেলুনিং এবং প্রদাহ দ্বারা চালিত, তথাপি ফাইব্রোসিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার এবং লিভার ফেইলিওর এর মত আরো গুরুতর রোগের পর্যায়ে যেতে পারে।
৪) ন্যাশ এর পরিসংখ্যান বাংলাদেশ এবং বিশ্ব :
এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ফ্যাটি লিভার রোগে প্রায় ৭.৬% মানুষ আক্রান্ত যা আমাদের মোট জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ। এর মধ্যে ১০% মানুষ ন্যাশে আক্রান্ত। আবার ঐ ১০% ন্যাশ আক্রান্তদের মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত প্রায় ১০ ভাগ মানুষ। বাংলাদেশে শিশু, কিশোর, মহিলা ও মধ্যবয়সী ব্যাক্তিদের মধ্যেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। ফ্যাটি লিভার রোগ বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। সারা বিশ্বে ১১৫ মিলিয়নের ও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে বাংলাদেশেও এই রোগের বিস্তৃতি ঘটেছে। যদিও বা এক সময় আমাদের দেশে পানি বাহিত ও রক্তবাহিত ভাইরাল হেপাটাইটিস এর প্রকোপ বেশি ছিল কিন্তু বর্তমানে ফ্যাটি লিভার রোগ সামনের দিকে চলে এসেছে।
৫) ন্যাশ নিয়ন্ত্রণে শরীর চর্চার বিকল্প নেই :
এই লিভার রোগটির সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নিয়মিত খাদ্যাভাস ও জীবন ধারা পরিবর্তনের উপর জোর দিতে হবে। বিশেষ করে কাঁচা লবণ, চিনি, ভাত, গরুর মাংস, খাসির মাংস, চিংড়ি খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া নিয়মিত শরীর চর্চার মাধ্যমে ক্যালরি বার্ণ করে শরীরকে সুস্থ রাখতে হবে। ন্যাশ প্রতিরোধে নিয়মিত হাঁটা ও দৌড়ানোর পাশাপাশি শিশুদের জন্য খেলার মাঠ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই রোগে আক্রান্ত। ধারণা করা হয় যে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া ও ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়া এই রোগের অন্যতম কারণ।
এখনো পর্যন্ত এই রোগের কোন কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তবে খাদ্যাভাস, ব্যায়াম ও ওজন কমানো একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে। এই রোগ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন: হৃদপিন্ড, স্নায়ু (ব্রেইন) ও লিভারকে আক্রান্ত করে, ফলে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পরিশেষে বলা যায়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে লিভার রোগের প্রধান নির্ণায়ক হবে ফ্যাটি লিভার। তাই সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, হেপাটোলজি (লিভার) বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।