মানব দেহের ছাকনি হল কিডনি। শরীর সচল রাখতে কিডনির ভূমিকা অপরিসীম। মানব দেহের কিডনির গুরুত্ব ও কিডনির রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর মার্চ মাসে কিডনি দিবস পালন করা হয়। এবছর বিশ্বজুড়ে ৯ মার্চ কিডনি দিবস পালিত হবে।
এবছরের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়– সুস্থ কিডনি সবার জন্য, অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের প্রস্তুতি, প্রয়োজন ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তা। বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন কিডনির কোনে না কোনো অসুখে আক্রান্ত। প্রতি ১০ জনে ৯ জনই নিজেদের রোগ সম্পর্কে জানেনই না, এখানেই জিতে যাচ্ছে রোগ। সচেতনতার অভাবেই মারা যাচ্ছে মানুষ।
কিডনি রোগ কি?
কিডনি মানব দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যাকে বাংলায় বৃক্ক বলা হয়। কিডনির মূল কাজ হচ্ছে আমাদের শরীরের দূষিত পদার্থগুলো পরিশোধন করে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া। কিডনিতে যখন কোনো সমস্যা হয় অর্থাৎ কিডনি যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন তাকে কিডনি রোগ বলা হয়।
কিডনি রোগের কারণ কি কি?
কিডনি অসুস্থ হওয়ার ধরন সাধারণত দুই ধরনের –
১। স্বল্প মেয়াদি কিডনি বিকল হওয়া (Acute Kidney Disease )
২। দীর্ঘ মেয়াদি কিডনি বিকল হওয়া (Chronic Kidney Disease )
কিডনির কাজ : কিডনির মূল কাজ হলো পুরো শরীরের রক্ত পরিশোধিত করা এবং দূষিত বর্জ্য বের করে দেওয়া। প্রতিদিন একটি কিডনি ১২০ থেকে ১৫০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে এবং দেড় থেকে দুই লিটার দূষিত বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়। পানি হোক, লবণ হোক, দূষিত যে কোনো কিছুই কিডনি শরীর থেকে বের করে দেয়। এসব দূষিত বর্জ্যের ৯৫ ভাগের বেশী প্রস্রাবর মাধ্যমে বের হয়ে যায়। বাকি বর্জ্য কিছু ঘামের মাধ্যমে বের হয়, কিছু পায়খানার মাধ্যমে বের হয় এবং কিছু শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের হয়। কিডনি প্রয়োজনীয় পানি রেখে অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়। কিডনি আমাদের শরীরে রক্ত উৎপাদনের জন্য Erzthropoietin নামক কেমিক্যাল নিঃসরণ করে, এজন্য কিডনি বিকল রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। কিডনি শরীরে লবণ ও পানির ভারসাম্য বজায় রাখে।
১.স্বল্প মেয়াদি কিডনি বিকল : স্বল্প মেয়াদি কিডনি বিকলকে ইংরেজিতে Acute Kidnez Failure বলা হয়। হঠাৎ করে কিডনি তার কাজ করার ক্ষমতা হারানোর ফলে এই রোগ হয়। এর প্রধান কারণগুলো হল– পানি শূণ্যতা (অতিরিক্ত ডায়রিয়া ও অতিরিক্ত বমি), হঠাৎ করে শরীরে রক্ত চলে গেলে (Acute Blood Loss )
কিডনির ক্ষতিকর ওষুধ সেবন (Painkiller, Antibiotics ) ইনফেকশন।
২. দীর্ঘ মেয়াদি কিডনি বিকল : সাধারণত যখন তিন মাস বা তার চেয়ে বেশী সময় ধরে কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখনই তাকে দীর্ঘ মেয়াদি কিডনি বিকল বা Chronic Kidnez Failure (CKD) বলা হয়, এর কারণগুলো হলো– টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পলিসিস্টিক কিডনি, বংশগত কিডনি রোগ, বয়স জনিত কিডনির সমস্যা, প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া, কিডনিতে পাথর হওয়া, গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস, ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস, মূত্রথলির প্রদাহ এবং ঘনঘন প্রস্রাবের ইনফেকশন
কিভাবে বুঝবেন আপনি কিডনি রোগে আক্রান্ত : কিডনি রোগ হলো নিরব ঘাতক। ৫০ ভাগ অকেজো হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায়না। এরপর যেসব লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়–শরীর ফুলে যায়, আর ফোলাটা যদি শুরু হয় মুখমণ্ডল থেকে ক্ষুধামন্দা, বমিভাব, দুর্বলভাব ও রক্তশূন্যতা দেখা; কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপ; অল্প হাঁটার পর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা তাড়াতাড়ি ক্লান্তি অনুভব করা; প্রস্রাব কমে যায় আবার বেড়েও যেতে পারে, যেমন– ডায়াবেটিস রোগীদের বেড়ে যায়; প্রস্রাব করার সময় জ্বলন অনুভব করা এবং প্রস্রাবে রক্ত বা পুঁজের উপস্থিতি; কোমড়ের দুই পাশে যদি ব্যথা হয়, এ ব্যথা তলপেটেও হতে পারে।
কিডনি ভালো রাখার উপায় ও প্রতিরোধে করণীয় : যে কোনো ব্যক্তির উচিত ৪০ বছরের পরে একবার হলেও কিডনি পরীক্ষা করা। বছরে দুই–একবার হলেও পরীক্ষা করলে কিডনি রোগ ধরা পড়ে এবং আগামী দুই–এক বছরে হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটিও বুঝা যায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ১৫ থেকে ২০ বছর পর কিডনি রোগ হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে ৭ থেকে ১০ বছর পরে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও শতকরা ৩০–৪০ ভাগ মানুষের কিডনি ফেইলিওর হয়। রোগীরা খুব দ্রুত চিকিৎসা নিলে ৯০–৯৫ ভাগ রোগী ১–২ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কিডনি ফেইলিওর প্রতিরোধে করণীয় : ডায়রিয়া ও বমি হলে একবারে কিছু করতে না পারলে যে পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয় সেটি রিপ্লেস করে নেয়া, নেফ্রাইটিস থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে, প্রসবকালীন জটিলতা পরিহার করতে হবে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, প্রস্রাব আটকিয়ে না রাখা, নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা, লবণ পরিহার করা, কোমল পানীয় খাওয়া থেকে বিরত থাকা, ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকা, মদ্যপান ও ধূমপান থেকে বিরত থাকা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, অতিরিক্ত ভিটামিন–সি খাওয়া যাবে না, সব সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই আসুন সময় থাকতে সবাই কিডনির যত্ন নিই।
লেখক : এসোসিয়েট কনসালটেন্ট (নেফ্রোলজি), এমবিবিএস, এমডি, নেফ্রোলজি, বিএসএমএমইউ, এমএসিপি (ইউএসএ), এফএএসএন (ইউএসএ)












