মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। এই ফাঁকে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করার ঘটনা। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদাকে আটকের সময় যেভাবে মব জাস্টিস করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে যদি কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২৩ জুন সকালে তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক হর্টিকালচার সেন্টার পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রোববার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। তাকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। উত্তরা এলাকা থেকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে আটক করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ‘মব ভায়োলেন্স’ বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাঁকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মামলা হলেই যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, সে বিষয়েও সরকারের স্পষ্ট অবস্থান আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিল, সরকার সবাইকে আশ্বস্ত করতে চায়, মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই–বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একদল ব্যক্তি মামলার আসামিকে ধরে হেনস্তা করছেন। তারপর পুলিশে দিচ্ছেন। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে কোনো তদন্ত ছাড়াই আসামিকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা ও চাপের মুখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তাঁরা বলেন, দেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় কোনো নাগরিক যদি কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যায় আচরণের শিকার হন, এর প্রতিকারের জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। বিচার করার একমাত্র এখতিয়ার আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদালতের।
ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কে গ্রেপ্তার করতে পারবেন, কে পারবেন না, সেটি বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধিতে উল্লেখ রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, পুলিশ ছাড়াও বেসরকারি ব্যক্তি আমলযোগ্য (গুরুতর) অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে আটক করতে পারেন। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কেবলমাত্র যখন কোনো ব্যক্তি এমন অপরাধ সংঘটিত করেন, যে অপরাধ জামিনযোগ্য নয়, সেই অপরাধ ওই ব্যক্তির সামনে সংঘটিত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে আটক করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা, গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ায় শাস্তির ভয় না থাকা–এ দুটোর সঙ্গে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনাপ্রসূত প্রতিহিংসা, সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা ও সামষ্টিক আচরণ বা চরিত্র যোগ করলে তৈরি হয় এক ভয়ংকর সংমিশ্রণ, যা জনতাকে প্ররোচিত করে নিজের হাতে ‘বিচার’–এর দায়িত্ব তুলে নিতে; ‘ন্যায়বিচার’, জয় অথবা ক্ষমতার স্বাদ অনুভব করতে। যা মানুষ একা করতে অক্ষম, তা তার পক্ষে সম্ভব হয় দল বেঁধে। তার শিকার হয় অনেক দুর্ভাগা নিরপরাধ মানুষ। এর অবসানের উপায় কী? যেহেতু এর মূল কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি; ন্যায়বিচার বঞ্চনা–উদ্ভূত প্রতিকার পাওয়ার ইচ্ছা, তাই এর সমাধানে এটা নিশ্চিত করতে হবে– কেউ যেন অপরাধ করে পার পেয়ে না যায়। সেটা যে কোনো ধরনের অপরাধ, যে–ই করুক না কেন। পাশাপাশি গণপিটুনির মতো ভয়ংকর বর্বরতায় লিপ্ত তাদেরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।