আধুনিককালে সংবাদ পরিবেশকদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও সংবাদপত্র শিল্পের বিস্তার ঘটেছে। দেশের রাজধানী শহরের বাইরে অনেক কেন্দ্র থেকে এগুলি প্রকাশিত হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা সংবাদপত্র বিলুপ্ত হবার খবরও পাই। কালের পরিক্রমায় সফলভাবে উল্লেখযোগ্য সময় ধরে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে এমন সংবাদপত্রের সংখ্যাও আমাদের দেশে কম নয়। সবিশেষ গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করতে হয় এমন কয়েকটির মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী অন্যতম। আজাদীর প্রকাশকাল অর্ধশতাব্দীর বেশি। এ সময়ে আজাদী দিনে দিনে সংবাদ পরিবেশন এবং পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি, পাঠক সংখ্যা সবদিক থেকে ঈর্ষণীয় দ্রুততায় বিকশিত হয়েছে।
১৯৬০ সালে বিশ্ব অলিম্পিক আয়োজিত হয় রোমে। সেখানে প্রথম অলিম্পিকেরও আসর বসেছিল। এ অলিম্পিক তখনকার পাকিস্তানের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছিল বিশ্বে এককালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের নিকট থেকে হকি প্রতিযোগিতার স্বর্ণপদক ছিনিয়ে নেয়ার জন্য।
আজাদী সে সময় নতুন পত্রিকা, চট্টগ্রাম থেকে বের হচ্ছে। ক্রীড়াপাগল চট্টগ্রামবাসীর এ ঘটনায় আজাদী পরিবেশিত খবরের জন্য সেকি আকুলতা! তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। কাগজ কিনে সংবাদ জানার অভ্যাস গড়ে উঠতে সময় লাগে। তবে কোন বিশেষ উপলক্ষে একবার কোন কাগজের উপর মন বসে গেলে সেটা প্রলম্বিত হবে কিনা তা নির্ভর করে পরিবেশিত খবরের বৈচিত্র্য এবং তা পরিবেশনের নৈপুণ্যের উপর। নতুন নতুন পাঠকও যুক্ত হন এ তালিকায় একই কারণে।
সেই ষাটের দশকে চট্টগ্রামে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম কলেজে কয়েকটি বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে সম্মান কোর্স প্রবর্তন ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন। এসব কারণে চট্টগ্রামের সাহিত্য, সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়। নতুন এক ঝাঁক তরুণ শিক্ষক শিক্ষার্থী যুক্ত হন শহরের অভিজাত শ্রেণিতে। আজাদী পত্রিকার প্রধান অফিস তখন আন্দরকিল্লায়। সন্ধ্যায় সেখানে মিলিত হন নতুন পুরাতন সাহিত্যসেবীরা। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কল্যাণে আজাদী সে সময় এই নতুন অতিথিদের মিলনমেলা।
এর মধ্যে শুরু হয় আইয়ুব খানের বনেদি গণতন্ত্রের নির্বাচন, প্রগতিশীল ছাত্র শিক্ষকদের মোর্চার আবির্ভাব এবং পরবর্তীতে দেশের বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিবেশে গণ আন্দোলন। উত্তাল ষাটের দশক জুড়ে আজাদী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে চট্টগ্রামের জাতীয় কণ্ঠ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দৈনিক আজাদী পত্রিকার সাহসী ভূমিকা এখন ইতিহাসের অংশ।
আজাদী পাঠকপ্রিয় পত্রিকা। সংবাদ বৈচিত্রে, বিন্যাসে ও পরিবেশনায় আজাদী দিনে দিনে উৎকর্ষ লাভ করেছে। দেশের সংবাদ, আন্তর্জাতিক সংবাদ, স্থানীয় সংবাদ যেমন একদিকে পুরো বিশ্বকে পাঠকের নিকট হাজির করছে তেমনি বিনোদন সংবাদ, ক্রীড়া সংবাদ, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংবাদ ভিন্ন ভিন্ন পাঠককুলের রুচি, আগ্রহ অনুযায়ী তাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করছে। সমাজের অনগ্রসর, সুবিধাবঞ্চিত এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠীর বিশেষ প্রয়োজন এবং অভাব অভিযোগ সম্বলিত বিশেষ প্রতিবেদনও আজাদীর নিয়মিত প্রবাহের অন্তর্ভুক্ত।
পরিবেশনার গুণে আজাদী পাঠকের মনের কাছে পৌঁছে যাবার চেষ্টা করে। পাঠককে উদ্দেশ্য করে খবর পরিবেশন করার মূল লক্ষ্য (পঠিত) খবর থেকে পাঠক যা চান তা যেন পরিপূর্ণভাবে আহরণ করতে পারেন। এর মানে অবশ্য পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য চটকদার বর্ণনা বা ঘটনার ব্যতিক্রম কিছুর অবতারণা করা নয়। এটি সৎ সাংবাদিকতার পরিপন্থী। বরং ঘটনাটিকে বৃহত্তর বিষয়ের প্রেক্ষাপটে যাচাই করার মত করে পাঠকের মনকে সমৃদ্ধ করার উৎসাহ সৃষ্টি করার প্রয়াসই সফল পরিবেশন। আজাদীর কোন কোন খবর পাঠ করার পর সে খবরটি পাঠক সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যান এমনটি আমার মনে হয়না। বরং খবরের ভেতর যেন আরো খবর থাকার আভাস পান। সবসুদ্ধ খবরটা উপভোগ করার তাগাদা জন্মে। এরকম অনুসন্ধিৎসু পাঠক তৈরি করাও পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য। পাঠক ঋদ্ধ হন এবং পত্রিকাটিতে তাঁর আস্থা দৃঢ় হয়। এই শ্রেণির পাঠক আজাদী তৈরি করতে পেরেছে বলেই আজাদীর পথ পরিক্রমা নির্বিঘ্ন হয়েছে।
আজাদী ক্রমাগতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলিকে অধিকতর গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে। এতে তার স্থানীয় পত্রিকা থেকে জাতীয় পত্রিকায় উত্তরণ ঘটেছে।
ইংল্যান্ডে উত্তর অঞ্চলের দু’টি শহর লীডস এবং ম্যানচেস্টার যথাক্রমে ইয়র্কশায়ার এবং লায়ঙ্কাশায়ার কাউন্টি দুটির প্রধান শহর। সেখানে ইয়র্কশায়ার পোস্ট এবং ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান দু’অঞ্চলের দুটি পত্রিকা। ইয়র্কশায়ার পোস্ট তার হেডলাইনে নিজেকে ইয়র্কশায়ার এর জাতীয় দৈনিক বলে প্রচার করে এবং ইয়র্কশায়ারের গৌরব বিষয়ে সচেতনভাবে প্রায় প্রচারধর্মী সংবাদই অধিক গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। কিন্তু, দি ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকাটি আস্তে আস্তে নিজেকে আঞ্চলিক গণ্ডির সংবাদপত্র থেকে মুক্ত করে এক সময় জাতীয় এবং প্রথম সারির আন্তর্জাতিক পত্রিকায় উন্নীত করতে পেরেছে। দি গার্ডিয়ান নামে বিশ্বব্যাপী তার প্রচার। আজাদী ভবিষ্যতে কোন পথ নেবে সেটা তাদেরই ভাববার বিষয়। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে বলা যায়, এ পত্রিকার জন্য কোন বিকল্পই অলীক নয়।
লেখক : উপাচার্য, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি