মাটি ও মানুষের জন্যই রাজনীতি। নিজের নয়, দশের জন্য উৎসর্গীকৃতরাই গণমানুষেন হৃদয়ে আসন গড়েছেন। হয়েছেন চিরস্মরণীয়। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এঁদেরই একজন। যিনি ছিলেন বিশাল হৃদয়ের দেশ দরদী মানুষ। মৃত্যুতে তাই নিঃশেষ নন। আজো দুঃখী, সহায়হীন, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ বাবু ভাইয়ের অস্তিত্ব অনুভব করে। আখতারুজ্জামান বাবু ভাই ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বেশ কয়েকবার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের কঠিন সময়ে বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পরে মূলত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার জন্য যে কয়েকজন নেতা অর্থবিত্ত এবং নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দলের জন্য কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমাদের চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান এবং চট্টগ্রামের রাজনীতির অভিভাবক মরহুম আখতারুজ্জামান বাবু ভাই অন্যতম। বাবু ভাই বিশাল মনের মানুষ ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে প্রাণভরে ভালোবাসতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনেক অবদান ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছোট ভাইও শহীদ হয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে আমি যখন সাতকানিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম সে সময় আমি বাবু ভাইয়ের নাম শুনেছি, কিন্তু এই মহান ব্যক্তিত্বের সাথে আমার পরিচয় তখন হয়ে ওঠেনি। বাবু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয় আশির দশকে যখন আমি ছাত্রলীগের জেলা পর্যায়ে রাজনীতি করছি। বিশেষ করে পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জেল হত্যা বিচার এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্বরতার জন্য আমরা সেসময় যারা ছাত্র ছিলাম, তখন আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিটা এলাকায় গিয়ে জনমত সৃষ্টি করতাম। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও আমরা চট্টগ্রাম শহরে একটি কমিউনিটি সেন্টারে সমাবেশ করেছিলাম। সে অনুষ্ঠানে আমি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বাবু ভাই তখন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আমার সাথে তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৮২ সালে যখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, উনিও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে চারটি বছর উনার সাথে আমি কাজ করেছি সংগঠনের জন্য। এছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ে দলকে কিভাবে সংগঠিত করা যায় বাবু ভাইয়ের সাথে আমরা আলোচনায় মিলিত হতাম। ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে উনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন। একেবারে নিবিড়ভাবে উনার সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। উনি আমাদের সবসময়ই খোঁজখবর রাখতেন। মূলত তখন থেকেই বাবু ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।
বঙ্গবন্ধু যেভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন, দেশকে ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধুর একজন খাঁটি এবং সত্যিকারের কর্মী হিসেবে বাবু ভাইয়ের মধ্যে সে গুণাবলী ছিল। বাবু ভাই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ছিলেন। এছাড়া তিনি ট্রেড বডি চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি ও ৭৭ জাতি গ্রুপের সহ-সভাপতি ছিলেন। একজন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হয়ে উনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি রাজনীতিতে জড়িত থাকার পরও ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হিসেবে সফল ছিলেন। পাশাপাশি তাঁকে আমরা একজন দানবীর হিসেবে দেখেছি। যেখানে মানুষের সংকট সেখানে বাবু ভাই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যখন বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরে ব্যাংক সৃষ্টি হয় তখন বাবু ভাই চট্টগ্রামের উদীয়মান কিছু ব্যবসায়ী নিয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এটা থার্ড জেনারেশন ব্যাংক ছিল। উনি ইনস্যুরেন্স কোম্পানি তৈরি করেছিলেন।
বাবু ভাইয়ের এমন ব্যক্তিত্ব ছিল যে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ অন্যায় কথা বলার সাহস পেতেন না। তিনি গণতান্ত্রিক মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে সকল মতের মানুষ উনাকে ভালোবাসতেন। ব্যবসায়িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উনি অত্যন্ত একজন ভালো মানুষ ছিলেন। চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশের অনেক মানুষ তাঁর কাছে যেতেন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য। কেননা তিনি শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ব্যবসা বুঝতেন, তিনি শিল্পের অবকাঠামো বুঝতেন। কোন্ শিল্প করলে দেশ এগিয়ে যাবে ও কর্মসংস্থান সষ্টি হবে তা তিনি বুঝতেন। এছাড়া স্বৈরাচার জিয়া ও এরশাদ সরকারের আমলে বাবু ভাই আন্দোলনের অগ্রভাগে নেতৃত্বে ছিলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অন্য দল কিংবা সকল মতের মানুষকে সাথে নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি অন্য দলকেও প্রভাবিত করেছিলেন।
চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে বাবু ভাই অনেক কাজ করেছেন। বাবু ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের কারণে এসব সম্ভব হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে সম্ভবত ২০১০ কিংবা ২০১১ সালে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে এসেছিলেন। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে তখন চট্টগ্রামের নেতাদের নিয়ে এক বৈঠকে বাবু ভাই সবাইকে নিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য এক অভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তখন চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়ন বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছিল। বৈঠকে চট্টগ্রামের উত্তর-দক্ষিণ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বাবু ভাই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ইতোমধ্যে সেসব উন্নয়ন প্রকল্পের অনেকগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে।
আমার একটা কথা এখনো মনে পড়ে, স্বৈরাচারী সরকার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে লালদিঘি মাঠে যখন ১৫ দলের সভা বানচাল করা হল, তখন সবাই গিয়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। সেদিন এক আলােচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছিল আন্দোলন নিয়ে সামনে কী করা যায়, সেই মুহূর্তে বাবু ভাইয়ের বাসা থেকে উনিসহ ১৫ দলীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সবাইকে বান্দরবান কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
চট্টগ্রামের যেকোনো ব্যাপারে বাবু ভাইয়ের কথার বাইরে বোধ হয় কেউ যাননি। বাবু ভাই সেসময় সভাপতি হিসেবে ছিলেন, পরবর্তীতে দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হন। বাবু ভাই সকলের সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন, তিনি সুসম্পর্ক রাখতেন বলে সকলকে একত্রিত করে রাখতে পারতেন, একত্রে কাজ করতে পারতেন। বাবু ভাই বিশাল মনের মানুষ ছিলেন। তিনি সবাইকে মিত্র মনে করতেন। কাউকে শত্রু মনে করতেন না। বাবু ভাই সবাইকে এক মনে করতেন, নিজের মনে করতেন। ২০১২ সালে ৪ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি সিঙ্গাপুরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বাবু ভাইয়ের মৃত্যুর খবর যখন বাংলাদেশে আসল, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, আমার মনে হয় সেদিন কি ধরনের ও কোন মাপের মানুষ তিনি ছিলেন আমরা সেটা বুঝতে পেরেছি। মৃত্যুর আগে আমরা তাঁকে বুঝতে পারিনি, মৃত্যুর পর আমরা গভীরভাবে তাঁকে বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় সেদিন যে সব দেশগুলোতে বাংলাদেশি আছে, সেসব দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। ঢাকা, চট্টগ্রামের পর সর্বশেষ উনার জানাজা যখন গ্রামের বাড়িতে হয়েছিল, সেদিন সেখানে শোকের মিছিল হয়েছিল। বাবু ভাই যেভাবে মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, সাধারণ মানুষও তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন।
পদ-পদবি নিয়ে মানুষের মূল্যায়ন হয় না, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তাঁর মূল্যায়ন হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাবু ভাই মানুষের কাছেই মূল্যায়িত হতে চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সিঙ্গাপুর থেকে হালদা পর্যন্ত যে শোকের মিছিল হয়েছিল সেখানেই তাঁর মূল্যায়ন হয়েছে। মানুষ সেভাবে উনাকে মূল্যায়ন করেছে। বাবু ভাই পদ-পদবির জন্য রাজনীতি করেননি। বাবু ভাইকে আমাদের নেতা-কর্মীরা দক্ষিণ জেলা সভাপতি করেছিল, তাঁকে দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরাই তো বাবু ভাইকে মূল্যায়ন করব। এই পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে বাবু ভাইও আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। একবার ২০০৮ সালে নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁকে মন্ত্রী করা হবে। কিন্তু তাঁকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। বাবু ভাইকে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে মন্ত্রী করা হয়নি। তিনি তখন বলেছিলেন, আমার নেত্রী যখন যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা আমাদের সবাইকে মেনে নিতে হবে। এভাবে বাবু ভাই সে ব্যাপারটি নিয়ে কোনো আক্ষেপই করেননি। হয়তো বাবু ভাইয়ের অনেক বন্ধু, সহকর্মীরা সেদিন মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। বাবু ভাই মন্ত্রিত্ব দিয়ে তাঁর মূল্যায়ন চাননি। তিনি ভালোবাসা দিয়ে মূল্যায়ন পেতে চেয়েছিলেন। আরেকটা কথা বলতে হয় যে, বাবু ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে এমপি হয়েছিল পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মন্ত্রিত্বের মর্যাদা দেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী আছে বাংলার প্রতি প্রান্তরে। মানুষের হৃদয়ের গহীনে। রবে চিরকাল। দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবু ভাই আপনাকে অজস্র শ্রদ্ধা, সালাম।
লেখক : পরিচালক-রূপালী ব্যাংক, প্রধান সম্পাদক-সাপ্তাহিক চট্টলা।