একেবারে পিনপিনে একটি সূতি পাঞ্জাবি। হাতে এবং গলায় দারুণ কাজ করা। ফেসবুক ওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে চমৎকার পাঞ্জাবিটির ছবি। যে কারো পছন্দের পাঞ্জাবি কেনার জন্য ক্লিক করলেই যোগাযোগ হচ্ছে ইনবক্সে। পাঞ্জাবির দাম বলা হচ্ছে মাত্র ছয়শ টাকা। এমন একটি পাঞ্জাবির দাম মাত্র ছয়শ টাকা যেন ‘পানির দাম’। যে কেউ এতে আকৃষ্ট হবে। এমন একটি পাঞ্জাবির কাপড় কিনতেও এক হাজার টাকা লাগার কথা, সেলাই আছে কমপক্ষে পাঁচশ টাকা। তাহলে পাঞ্জাবি ছয়শ টাকায় কি করে দেয়া হবে? এই প্রশ্নে কিছুটা খটকা লাগলেও উত্তর জুটছে শহরে। পাইকারি দামে তারা খুচরা বিক্রি করছে। টাকা ক্যাশ অন ডেলিভারি। তবে ডেলিভারি চার্জ হিসেবে দেড়শ টাকা আগাম পাঠাতে হবে।
আর এখানেই ঘাপলার শুরু। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অগণিত মানুষের কাছ থেকে এভাবে পাঞ্জাবি ডেলিভারির টাকা হাতানো হলেও কেউ পাঞ্জাবি পাননি। শুধু পাঞ্জাবিই নয়, এভাবে নানা পণ্যের ডেলিভারি চার্জের নামে আগাম টাকা নিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বহু টাকা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহ দেয়ার আগাম টাকা নিয়েও গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। দুয়েক হাজার টাকার জন্য অনেকেই বাড়াবাড়ি করেন না। আবার অনেকেই ওই সাইট থেকে সংশ্লিষ্ট কাস্টমারকে ব্লক করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ফোন ধরছে না। ব্লক করে দিচ্ছে। সারাক্ষণই এনগেজড পাওয়া যায়।
করোনাকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহু মানুষেরই ভরসার জায়গা হয়ে উঠা অনলাইন ব্যবসা নিয়ে নানা প্রতারণা চলছে। বিভিন্ন প্রতারক চক্র নিত্য নতুন কৌশলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নানাভাবে প্রতারিত মানুষের কাছে অনলাইন ব্যবসা নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে দেশে অনলাইন ব্যবসা শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই দেশে অনলাইন ব্যবসার কার্যক্রম চলছে। তবে করোনাকালে দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালে বিভিন্ন ই-কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স সাইটগুলো বহু মানুষেরই কেনাকাটার অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠে। হাজার হাজার মানুষ চাল ডাল থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত কিনে অনলাইনে। কোরবানির গরুর পাশাপাশি মাছ মাংসও কেনা হয়েছে অনলাইনে। মহিলাদের শাড়ি গয়না থেকে শুরু করে ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্য অনলাইন শপিং থেকে কেনাকাটা করেন। শপিং মল বন্ধ থাকা, দোকানপাট লকডাউনের আওতায় থাকা, গণপরিবহনসহ যান চলাচল বন্ধ থাকাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় মানুষের অবলম্বন হয়ে উঠে হোম ডেলিভারির অনলাইনে কেনাকাটা। করোনাকালে অনলাইন কেনাকাটার বিশাল বাজার গড়ে উঠে। শত শত কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয় অনলাইনে। একটি সমীক্ষার উদ্বৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে আনুমানিক ২৫০০ ই-কমার্স সাইট রয়েছে। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে দেড় লাখেরও বেশি। এসব প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন লক্ষাধিক পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি হচ্ছে। বর্তমানে ই কমার্সের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৭৫ শতাংশ। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল একটি বাজার তৈরি হয়েছে। আর মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যে এই বাজার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেও ওই সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। দিনে দিনে বিস্তৃতি লাভ করা অনলাইন বাণিজ্যের সুযোগে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারকচক্র সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিভিন্ন ধরণের পণ্যের লোভনীয় অফার দিয়ে ডেলিভারি চার্জের নামে টাকা অগ্রিম নেয়া, পণ্যের মূল্য বাবদ অগ্রিম টাকা নেয়া, এক ধরনের পণ্যের ছবি দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য গছিয়ে দেয়াসহ নানাভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে। প্রতারকদের লাগামহীন তৎপরতায় সম্ভাবনাময় অনলাইন ব্যবসা বড় ধরনের হুমকিতে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
রাধুনী অনলাইন ব্যবসার অন্যতম স্বত্তাধিকারী মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরী গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ঘরে সব ধরনের পণ্য পৌঁছে দিই। পণ্য ডেলিভারি দেয়ার পরই আমাদের লোকজন টাকা পয়সা নিয়ে আসে। পুরো ব্যাপারটি বিশ্বাস এবং আস্থার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে ছিঁড় ধরলেই এ ব্যবসা মাঠে মারা পড়বে।
জাকির হোসেন রোডের আজমীর মসলা হাউজের স্বত্ত্বাধিকারী আরিফ জয় বলেন, অনলাইন অর্ডারের ভিত্তিতে আমরা পণ্য সরবরাহ দিই। আমরা অনলাইনে যেভাবে ঘোষণা দিই ঠিক সেই মানের পণ্যই ডেলিভারি দিই। অনেক প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করে আরিফ জয় বলেন, এই খাতটি অনেক বড় এবং সম্ভাবনাময় একটি খাত। এটিকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং একটি কার্যকর নীতিমালা ঘোষণার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।
প্রসঙ্গক্রমে সূত্র জানিয়েছে, অনলাইন ব্যবসার উন্নয়ন, আস্থা ধরে রাখাসহ ডিজিটাল ব্যবসা পরিচালনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সঠিক নজরদারির অভাবে এই নীতিমালা কার্যকর হচ্ছে না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
কার্যকর নীতিমালা, সঠিক নজরদারি এবং সর্বোপরি ক্রেতারা সচেতন না হলে প্রতারকদের সামলানো কঠিন। ক্রেতাদের সচেতনতার উপর গুরুত্বারোপ করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কি ধরণের পণ্যের অর্ডার করছেন, ব্যক্তিগতভাবে ওই ব্যবসায়ীকে চিনেন কিনা, ব্র্যান্ড ইমেজ সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। সঠিক নজরদারি এবং প্রতারকদের আইনের মুখোমুখি করা গেলে অনলাইন ব্যবসায় আস্থার সংকট কেটে যাবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।