এরা বেশ পয়সাওয়ালা, বলতেই হবে। দামী সোফা, আলো ঝলমলে ঝাড়বাতি, মেঝেতে চোখ ধাঁধাঁনো কার্পেট, দেয়াল জুড়ে দামী দামী তৈল চিত্র–সব মিলিয়ে ঘরটাকে আলিশান ঘর বলা যায়। এই ঘরের এক মাত্র কন্যা দিপা, যার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। রহমান সাহেবের মত এত ধনী লোক তার মেয়ে দিপাকে কেন আমার কাছে পাত্রস্থ করতে চান, আমি ভেবে কূল পাই না। আমার মত নিন্মবিত্ত ঘরের সাধারণ এই চাকুরিজীবি ছেলেতে কি দেখেছেন তিনি কে জানে। হয়তো আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি চেহারাতে অন্য সবার মত আকর্ষণীয় এক মায়া দেখে রহমান সাহেব নিজের মেয়ের জন্য আমাকে পাত্র নির্বাচন করেছেন।
যে ঘরে এখন আমি দিপার মুখোমুখি বসে আছি, এটা দিপার ঘর। রূপকথার গল্পের রূপবতী রাজকন্যাদের যেরকম ঘর হয়, দিপার ঘরটা অনেকটা সেরকম। দামী দামী আসবাব পত্রে সজ্জিত এ–ঘরে আমাকে পাঠানো হয়েছে দিপার সাথে একান্ত কোনো কথা থাকলে সেটা সেরে নেয়ার জন্য। ক্ষীণ গলায় বললাম-‘পাত্র হিসেবে আমাকে তোমার কতখানি পছন্দ হয়েছে জানি না, তবে তুমি ভারী মিষ্টি।’ আমার কথায় ম্লান হেসে দিপা বলল-‘ইয়ে মানে…।’ দিপার মুখ থেকে আর কথা বের হচ্ছে না। সে আমতা আমতা করতে থাকল। সাহস দিয়ে বললাম-‘তুমি সংশয়ে কিছু বলতে পারছো না? কোনো কথা থাকলে দ্বিধা না রেখে আমাকে বলো। তোমাকে কিন্তু আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে।’ দিপা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল-‘আপনাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই। সুশিক্ষার পাশাপাশি আপনি দারুণ স্মার্টও। এ কারণে বাবা আমার জন্যে আপনাকে পছন্দ করেছেন। যদিও আমাদের অবস্থান আর আপনাদের অবস্থানে দীর্ঘ ব্যবধান।’ দিপার কথায় আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলাম। বেশ সুন্দর করে কথা বলার গুণ আছে এই মেয়ের।
আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে দিপা বলল-‘আমি কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। কারণ আমার বিয়ে আরো দুমাস আগে হয়ে গেছে। ভালোবেসে আমি আর সজল কোর্ট ম্যারেজ করেছি। আমার পরিবার এখনো এ–গোপন সংবাদ জানে না।’ দিপার কথায় আমি আকাশ থেকে পড়লাম এবং আমার তখনই মনে হল আজ আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এখানে অযথা এসেছি। বাবা আগ্রহ নিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়ে ভুল করেছেন।
দিপা আমাকে বলল-‘প্লিজ আমার বাবাকে বলবেন যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। এই সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিতে এবং আমাকে বাঁচাতে আপনি কি পারবেন না একটি মিথ্যে অজুহাত আমার বাবাকে দেখাতে?’ আমি নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম-‘পারব। আমার একটি মিথ্যে কথায় যদি তোমার উপকার হয়, ক্ষতি কি। তুমি চিন্তা করো না।’
আমি নিচতলায় ফিরে এলাম। রহমান সাহেব আমার অপেক্ষায় ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন। আমার আগমনে উঠে দাঁড়ালেন এবং আহ্বানের সুরে বললেন-‘আমার মা মরা মেয়েটাকে কেমন দেখলে বাবা! দিপা খুব চমৎকার ছবি আঁকে।’ আমি নিচু গলায় বললাম-‘আংকেল আমি এখন যাই। আমার বাবা আপনাকে পরে ইয়েস অর নো জানাবে।’ রহমান সাহেব হো হো করে হেসে বললেন-‘আচ্ছা যাও বাবা। সাবধানে যাবে। ড্রাইভারকে গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিতে বলব?’ এক বাক্যে বললাম-‘না।’
২.
আমার আসার অপেক্ষায় থাকা বাবা মা দুজনে আমাকে দেখে কৌতূহল নিয়ে ছুটে এসে বলল-‘কিরে, রহমান সাহেব কি বলল?’ জবাব না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মা বাবাকে বললেন-‘তুমি এখান থেকে যাও তো। ও তোমার সামনে বলতে শরম পাচ্ছে।’ বাবা মুচকি হেসে পাশের ঘরে চলে গেল।
মা কণ্ঠে রাজ্যের আকুলতা এনে বললেন-‘মেয়েটা কেমন রে? শুনেছি দেখতে নাকি আসমানের চান! ওই মেয়ের সাথে তোর বিয়েটা হলে আমাদের ভাগ্যটা বদলে যাবে।ওরা অনেক বড়লোক।’ মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম-‘মা, দিপাকে আমার পছন্দ হয়নি। এ বিয়ে হচ্ছে না।’ বলেই আমি স্থান ত্যাগ করলাম। মা যেন আকাশ থেকে পড়েছেন–এমন ভঙিমায় হা করে তাকিয়ে রইলেন আর আমাদের ঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ধেয়ে আসা এক চিলতে শীতল বাতাস মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে গেল। মায়ের দুঃখি মুখ, অথচ মাকে দেখতে কি অপূর্বই না লাগছে।