বহুগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সমাজ সেবক। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতার অন্যতম। কর্মজীবনে সব জায়গায় দীপ্তি ছড়িয়ে কাজ করেছেন সততার সাথে। লোভ কখনো তাড়িত করেনি তাঁকে। তাইতো সাদামাটা জীবন যাপন করেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। জীবনে অনেক পেশায় জড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে সাংবাদিক তথা সম্পাদক হিসেবে অধিক পরিচিত ছিলেন তিনি। শিক্ষক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী কোনো কিছুতে তিনি বেশিদিন স্থায়ীত্ব হননি। স্বনামধন্য গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে চাকরি করেছিলেন ১৯৫৪ সালে। সুনামের সাথে চাকরি করে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিলেতে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের জন্য বিলেতে তো যাননি উল্টো চাকরিই ছেড়ে দিয়েছিলেন তখনকার তরুণ ব্যাংকার খালেদ। কলেজের চাকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। নাজিরহাট কলেজে অধ্যাপনা করেছেন বছর দেড়েক। আইয়ুব খানের মার্শাল ল’র পর সেই চাকরিও ছেড়ে দেন। তার আগে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন সাহসী এই মানুষটি। এরপর এক সময়ে মামার হাত ধরে আসেন সংবাদপত্র জগতে এবং আমৃত্যু সংবাদপত্র জগতেই ছিলেন।
১৯৬০ সালে কোহিনুর প্রেসের মালিক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যখন দৈনিক আজাদী প্রকাশের উদ্যোগ নেন, তখন ভাগিনা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকেও সাথে নেন তিনি। মামা সম্পাদক, ভাগিনা সহ সম্পাদক। দুই বছর এভাবে চলার পর হঠাৎ মামা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মৃত্যুবরণ করলে ভাগিনা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ হাল ধরেন দৈনিক আজাদীর। সেই যে হাল ধরেছিলেন আমৃত্যু আর ছাড়েননি। একটানা ৪১ বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কিংবদন্তি সাংবাদিক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তিনি সাংবাদিকের চাইতে অধ্যাপক নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। অথচ অধ্যাপনা করেছেন মাত্র দেড় বছর। প্রকাশ আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নাকি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে মাঝে মধ্যে নাম ধরে না ডেকে শুধু অধ্যাপক বা প্রফেসর বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধু’র খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন হওয়ার পর মাত্র ৪টি পত্রিকা ছাড়া দেশের সব পত্রিকা বন্ধ করে দিলেও অধ্যাপক খালেদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু দৈনিক আজাদীকে ছাড় দেন।
রাজনীতিতে অধ্যাপক খালেদ খুব সফল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু থেকে রাজনীতির দীক্ষা নিয়ে তাঁর পথচলা শুরু। ছাত্র জীবনেই পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দুইজনেই পড়তেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন একই হোস্টেলে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি অগাধ ভালোবাসতেন। একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। জীবনে যত নির্বাচন করেছেন সব বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই করেছেন। নিজ থেকে কোনো নির্বাচন করেননি। ’৭০ এর আলোচিত নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের কাছে দরখাস্তই করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি নির্বাচন করেছেন এবং সেই নির্বাচনে হারিয়েছিলেন তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে। ১৯৭৩ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৫ সালে বাকশাল গঠন হওয়ার পর চট্টগ্রাম জেলার গভর্ণর নিযুক্ত হন। ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। কিন্তু তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। নির্লোভ ব্যক্তি ছিলেন অধ্যাপক খালেদ। ইচ্ছা করলে রাজনীতিবিদ হিসেবে অথবা সাংবাদিক তথা সম্পাদক হিসেবে অবৈধভাবে কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি ঐ পথে পা মাড়েননি। নিজের আদর্শকে বিসর্জন দেননি। সততার সাথে জীবন পার করেছেন স্বল্পভাষী বিবেকের বাতিঘর খ্যাত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতকদের হাতে শাহাদাত বরণ করার পর অধ্যাপক খালেদ খুব মুষড়ে পড়েন। এরপর আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে পুরোদমে সমাজসেবী হয়ে যান। তবে রাজনীতি থেকে সরে গেলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সরেননি আমৃত্যু।
কাজের প্রতি এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নিষ্ঠা ও ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। তিনি আজাদীকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। শুধু আজাদীর প্রচার তুলে ধরতে তিনি ছোট বড় যেকোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলে ছুটে যেতেন। তাঁর ভাষ্য ছিল আমি অনুষ্ঠানে গেলে আজাদীর নামটা সবাই মুখে নিবে। পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হবে সেই অনুষ্ঠানের সংবাদ। কিন্তু সংবাদে থাকবেনা আমার ছবি। থাকবে অন্য অতিথির ছবি। এতে পত্রিকাও বিক্রি হবে এবং ছবির ঐ ব্যক্তিও সম্মানিত হবে।
সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ লিখেছেন প্রচুর। কিন্তু উনার গ্রন্থ আছে মাত্র ১টি। ১৯৬৬ সালের সরকারি উদ্যোগে সৌদি আরবে ৩৫ দিন ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। সেই ভ্রমণের টুকরো স্মৃতি নিয়ে ‘সৌদি আরবে পঁয়ত্রিশ দিন’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ভ্রামণ পিপাসু অধ্যাপক খালেদ সৌদি আরব ছাড়াও আরো অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তার মধ্যে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, বৃটেন, মালয়েশিয়া অন্যতম। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সুযোগ্য সন্তান আছে ছয়জন। চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মোহাম্মদ জহির বাবার পথ অনুসরণ করে সাংবাদিকতায় এসেছেন। সাপ্তাহিক স্লোগানের সম্পাদক তিনি। ১৯৯১ সালের শুরুতে এই পত্রিকাটি ছিল মাসিক। বর্তমানে সাপ্তাহিক স্লোগান বেশ জনপ্রিয়।
যেকোনো ব্যক্তি বা মনীষী ধরাধাম ছেড়ে চলে গেলে তাঁকে সাধারণ মানুষের মাঝে, সমাজের মাঝে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের মাঝে আলোচনায় রাখতে হয় সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ঠিক তেমনি অধ্যাপক খালেদকে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে রেখেছেন চট্টগ্রাম একাডেমি এবং চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম একাডেমির ব্যানারে প্রতিবছর শিশুসাহিত্যে দুইজনকে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশু সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে আসছেন। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশের বই মেলা চলাকালীন সময়ে ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি মিলনায়তনে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে দেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের উপস্থিতিতে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি হয়। এ বছর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে শিশু কিশোরদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও শিশু সমাবেশ। উৎসবের নাম দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক খালেদ শিশু মেলা। এর আগে ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাপক খালেদের জীবনী গ্রন্থ। যেটি পাঠক মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষও প্রতিবছর অধ্যাপক খালেদকে স্মরণ করে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ জীবদ্দশায় অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম স্বর্ণপদক, চট্টগ্রাম সমাজ কল্যাণ পরিষদের সমাজসেবা মূলক স্বর্ণপদক এবং চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের কৃতি সাংবাদিক সংবর্ধনা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন মরণোত্তর। যদি জীবদ্দশায় তিনি এই পুরস্কারটি পেতেন তাহলে তাঁর অনুভূতি আমরা জানতে পারতাম। ঠিক যেমন এখন জানতে পাচ্ছি রাষ্ট্রের আরেক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হয়ে আজাদীর বর্তমান সম্পাদক এম. এ মালেকের অনুভূতি। দৈনিক আজাদী বাংলাদেশের একমাত্র পত্রিকা, যে পত্রিকার তিন তিনজন নক্ষত্র রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ তিন ক্যাটাগরির পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রথমটি পেয়েছেন আজাদীর বর্তমান সহযোগী সম্পাদক ও শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ। ২০১৬ সালে শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এরপর ২০১৯ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পুরস্কার পান মরণোত্তর। ২০২২ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক পান আজাদীর বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক। এই পুরস্কারগুলো আজাদীর জন্য মাইলফলক। আর চট্টগ্রামবাসীর জন্য প্রেরণার উৎস। অধ্যাপক খালেদ শুধু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার কিংবা রাজনীতি ও সাংবাদিকতার জন্য নয়, তাঁর সাদামাঠা পোশাকের ভেতর অসাধারণ চরিত্রের জন্য চট্টগ্রামবাসী তথা দেশবাসীর কাছে তিনি আজীবন স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মতো ব্যক্তিত্বরা কালেভদ্রে জন্মায়। আজ ৬ জুলাই এই মনীষীর শততম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি তাঁকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক